ট্রাম্প-কমলা: কে জিতলে বাংলাদেশের কী হবে?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। জাতীয় এ ভোট পরবর্তী প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি প্রতিনিধি সভা ও সিনেট গঠনও নির্ধারণ করবে।
এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত কয়েক সপ্তাহের জরিপে দুজনেরই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা গেছে।
ভোটের ফল যা-ই হোক না কেন, তা আগামী চার বছরের জন্য মার্কিন রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রসহ বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করবে। আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ভারমন্টে স্থানীয় সময় ভোর ৫টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
কানেকটিকাট, ইন্ডিয়ানা, কেনটাকি, মেইন, নিউজার্সি, নিউইয়র্ক এবং ভার্জিনিয়ার ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
ট্রাম্প বা কমলা, মার্কিন মসনদে যিনিই বসুন, বাংলাদেশের কী হবে? দক্ষিণ এশীয় দেশটির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটিও বড় প্রশ্ন।
তাছাড়া ভারতই বা এখানে কতটা ফ্যাক্টর হতে পারে? কিংবা বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন রাজনীতিদের সম্পর্ক কি কোনো ভূমিকা রাখবে?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। বিশেষ করে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি টুইটকে ঘিরে সেই আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অতীতে মার্কিন রাজনীতিকদের, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট নেতাদের ভালো সম্পর্ক দেখা গেছে।
বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলোয় জোর দেয় ডেমোক্র্যাট প্রশাসন। কমলা হ্যারিস বা ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে ব্যবসা-বাণিজ্য, সহযোগিতার জায়গাগুলো বাংলাদেশের জন্য সহজ থাকার সুযোগটা বেশি বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও লেখক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, কমলা হ্যারিস জয়ী হলে বর্তমান সম্পর্কের ধারাবাহিকতা ও সামঞ্জস্য বজায় থাকবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দুই দেশের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে।
মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, আমার মনে হয় না ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান সম্পর্কের কাঠামোকে সমর্থন করবেন। যেখানে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির উন্নয়ন, সংস্কার ও অন্যান্য সহায়তা বা সমর্থন করছে। ট্রাম্প ও তার প্রশাসন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রদানের ওপর জোর দেওয়ার মতো সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে বিশ্বজুড়েই আমেরিকার মানবিক সহযোগিতার জায়গা কমে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য অনিশ্চয়তার জায়গা হিসেবে রোহিঙ্গা ইস্যুও বড় বিষয়। কারণ জাতিসংঘের মাধ্যমে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য আসা সহায়তার বড় অংশই যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রথাগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখা যায়নি। তিনি যেভাবে বৈদেশিক নীতির জায়গাগুলো বিবেচনা করেন, সেটি ঘিরে অনিশ্চয়তাও থাকে। সাধারণত প্রেসিডেন্ট বদল হলেও বৈদেশিক নীতিতে খুব বড় পরিবর্তন হয় না। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা বা কাঠামোগুলোর একটা শক্তিশালী ভূমিকা থাকে।
তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পকে আমরা দেখেছি কিছু প্রচারণায় ইনস্টিটিউশনকে বদলে দেওয়ার কথা বলছেন। সেটা হলে একটা বড় পরিবর্তন হতে পারে। যদিও বিষয়টি আদৌ কতদূর সম্ভব হবে বা পররাষ্ট্র নীতির জায়গায় প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংখ্যালঘু নির্যাতন সংক্রান্ত একটি টুইট আলোচনা সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশে। তবে বিশ্লেষকেরা এটিকে ভবিষ্যৎ নীতির চেয়ে নির্বাচনে আমেরিকার হিন্দু ভোটার টানার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জায়গা থেকে তারা ধারণা করছেন, কিছু লবি গ্রুপ হয়তো বা এটাকে ইনফ্লুয়েন্স করতে চেয়েছে এবং সেই আলোকেই তার এই স্টেটমেন্টটা এসেছে।
লবি গ্রুপ বলতে আওয়ামী লীগ অথবা ভারতকে বোঝানো হয়েছে, এমন আলোচনাও রয়েছে।
বাংলাদেশে বিগত নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে শক্ত অবস্থানে থাকলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থনই একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন যে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, দুই পার্টির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভালো সম্পর্ক থাকায় এবং দুই শিবিরেই তার বন্ধু থাকায় এই নির্বাচনের ফলাফলে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না।
সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশ-আমেরিকার সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলা হলেও, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাস্তবতা ভিন্ন হতে পারে বলে মনে করেন মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে যখন ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছিলেন তার সমালোচনা করেছিলেন ইউনূস। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ বা মতাদর্শের জায়গাও ভিন্ন।
ফ্রান্সের এইচইসি প্যারিস নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে বক্তব্য দেওয়ার সময় ড. ইউনূস ট্র্যাম্পের জয়কে ‘সূর্যগ্রহণ’ বা অন্ধকার সময় হিসেবে বর্ণনা করেছেন বলে হেকের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া সেসময় আরেকটি অনুষ্ঠানে ট্রাম্পকে তিনি কী বলতে চাইবেন জিজ্ঞেস করা হলে, তখন ‘দেয়াল’ তৈরি না করে ‘সেতু’ নির্মাণ করে দৃষ্টিভঙ্গি উদার করার কথা এনবিসি নিউজকে বলেছিলেন ড. ইউনূস।
মি. কুগেলম্যানের মতে, কমলা হ্যারিস জিতলে ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সম্পর্কের জন্য একটা সম্পদ হবেন। কারণ, বাইডেন প্রশাসনের মতো কমলার ক্ষেত্রেও একটা স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থাকবে। তবে ট্রাম্প জয়ী হলে সে সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন বলেন, কমলা বা ট্রাম্প, যেই প্রেসিডেন্ট হোক না কেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে একটা নির্ভরযোগ্যতার জায়গা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামনের নির্বাচন দেরিতে হলেও কবে হবে, কীভাবে হবে, ধাপগুলো কী হবে, অর্থাৎ একটা রোডম্যাপ তুলে ধরতে হবে। এটা বর্তমান সরকারের বৈধতার ইমেজ এবং সমর্থনের জায়গা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।
অবশ্য বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকার জন্য বাংলাদেশ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর সুযোগ হবে বলেও মনে করেন হুমায়ুন কবির ও মেহনাজ মোমেন।
ব্যবসা বাণিজ্য, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক, এমন নানা দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা সম্পর্কে আগ্রহের জায়গা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেদেরকে বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে এই অঞ্চলে মনোযোগটা বাড়াচ্ছে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেখানে বাংলাদেশ কিন্তু একটা বড় জনগোষ্ঠীর দেশ যারা বেশ সক্রিয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে এশিয়ার সংযোগস্থল এবং বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে থাকায় সেখানে ভূরাজনৈতিক একটা আগ্রহ থাকে। সম্প্রতি সামরিক দিক থেকেও কিন্তু ডাইভার্সিফিকেশনের চিন্তা আমরা করছি। সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহী হবে।
বাংলাদেশকে ‘উঠতি বাজার’ বিবেচনায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের জায়গা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। উদাহরণ হিসেবে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জাম, বোয়িং বিমান, গ্যাস বা এলএনজির কথা উল্লেখ করেন এম হুমায়ুন কবির।
এছাড়া বাংলাদেশের বহু মানুষ আমেরিকায় বসবাস করেন, পড়াশোনা করতে যান। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বের জায়গা রয়েছে। প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও ক্রেডিট কার্ড বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে গেলেও তাতে কোনো না কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়।
বৈদেশিক নীতিতে সাধারণত বিশ্বের অন্যান্য দেশ বা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে স্বার্থের সমীকরণ গুরুত্ব রাখে। তবে আমেরিকার জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এবার নতুন সমীকরণের জায়গা অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সম্পর্ক। এসব নানাবিধ ফ্যাক্টর মিলেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কটা নির্ধারণ হবে।
(সূত্র:বিবিসি বাংলা)
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)