যশোরে ট্রেন-ট্রাক দুর্ঘটনা: ‘রেলগেট ছিল খোলা, ঘুমিয়ে ছিলেন গেটম্যান’
রেলক্রসিং খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ভুসিবোঝাই ট্রাক। তখন খুলনামুখী রকেট মেল ট্রেনটির সামনে পড়ে যায় ট্রাক। এ সময় ট্রেনের ধাক্কা খেয়ে ট্রাকটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে উল্টে যায়। তাতে ট্রাকের চালক ও তাঁর সহকারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
রোববার ভোরে যশোর সদরের চুড়ামনকাটি রেলক্রসিংয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে সেখানকার গেটম্যান পলাতক রয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাদের ভাষ্য, দুর্ঘটনার সময় ওই এলাকা কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। ওই সময় গেটম্যান ঘুমিয়ে ছিলেন। গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই মূলত দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। নিহত দুজন হলেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কাগমারী গ্রামের বাহাদুর মিয়ার ছেলে ট্রাকচালক পারভেজ হোসেন (৫০) ও মহেশপুর উপজেলার আজমপুর গ্রামের মৃত শহিদুল ইসলাম ওরফে শহিদের ছেলে হেলপার নাজমুল ইসলাম (৪০)।
পুলিশ জানায়, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চিলাহাটি থেকে খুলনামুখী রকেট মেল ট্রেনটি খুলনার উদ্দেশে যাচ্ছিল। ট্রেনটি যখন সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি রেলক্রসিং পার হচ্ছিল, এ সময় চৌগাছাগামী ভুসিবাহী একটি ট্রাক চলে আসে। রেলক্রসিংয়ের বার খোলা পেয়ে ট্রাকটি ভেতরে ঢুকে পড়লে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় বাসিন্দা চুড়ামনকাটি গ্রামের আনিসুর রহমান বলেন, ‘আজ ভোর থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত ছিল পুরো এলাকা। বাড়িতে থেকে বিকট শব্দ শুনে রাস্তায় বের হয়ে দেখি রেললাইনের পাশে উল্টে আছে বড় ট্রাক। ট্রাকটি দেখেই বুঝলাম ট্রেনের ধাক্কা খেয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, ট্রাকের ভেতরে দুটি মানুষ। দুজনই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। এরপর পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিস এসে ট্রাকের থাকা ভুসি সরিয়ে ট্রেন লাইন পরিষ্কার করে। আর নিহত দুজনকে যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।’ তিনি বলেন, এই রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বে ছিলেন চুড়ামনকাটির দাসপাড়া এলাকার সজল কুমার। তিনি গেট লাগানোর দায়িত্ব পালন না করে ঘুমিয়ে থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
ট্রাকচালকের সহকারী নাজমুলের মা নাসিমা বেগম বলেন, ‘ওরে ট্রাকে হেলপারি করতে নিষেধ করেছি। তারপরও আমার কথা না শুনে গাড়ি চালাতে যায়। গতকাল সন্ধ্যায় আমার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়। আর সকালে শুনি আমার ছেলে এই দুনিয়ায় নাই।’ আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, ‘দোষ সব এই গেটম্যানের। যদি রেলগেটের বারটি নামাত গেটম্যান, তাহলে আমার ছেলেটারে এভাবে জীবন দিতে হতো না। এতক্ষণ ছেলেটা আমার বুকে থাকত। চার বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছে। আমার একটাই ছেলে। এই ছেলেটা আমার সংসার চালাত। এখন আমার কী হবে! আমার সব শেষে হয়ে গেছে। আমার আর কিছু নেই। ও নাজমুল…। তুই আমারে ফেলাইয়া কই গেলি রে…বাবা। আমার সংসারের কী হবে!’
ট্রাকটির মালিক শাহীন হোসেন বলেন, ‘গতকাল শনিবার ঢাকার সিটি মিল থেকে ট্রাকে করে ভুসি নিয়ে আসছিল। ভুসিগুলো দেওয়ার কথা ছিল চৌগাছার শফি স্টোরে। গেটম্যানের ভুলের কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। ট্রেন আসার আগে গেটের বারটি লাগানো থাকলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলার কারণে আমার দুই কর্মচারীর প্রাণ গেল। একই সঙ্গে আমার ট্রাকটি শেষ হয়ে গেল।’
এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে যশোর সেনানিবাস ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
সিনিয়র স্টেশন কর্মকর্তা নাহিদ মামুন বলেন, ‘সকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে আমরা দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই। ভুসিবোঝাই ট্রাকটি উল্টে গেছিল। তার সামনের অংশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আমরা স্পট ডেড হিসেবে ট্রাকের চালক ও হেলপারকে উদ্ধার করি। আমরা রেললাইনের ওপর পড়ে থাকা ভুসি পরিষ্কার করি। পরে পুলিশ এসে ট্রেকার দিয়ে ট্রাকটি সরিয়ে ফেলে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ট্রেনের সঙ্গে ট্রাকের ধাক্কায় ট্রাকচালক ও হেলপারের মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি জিআরপি পুলিশের আওতায়। এই ঘটনায় আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। দুর্ঘটনার পর গেটম্যান পলাতক রয়েছেন।’
যশোর রেলের স্টেশনমাস্টার আইনাল হাসান বলেন, ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চিলাহাটি থেকে খুলনামুখী রকেট মেল ট্রেনটিতে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর খুলনাগামী সব লাইনে ট্রেন কিছুক্ষণ চলাচল বন্ধ থাকে। পরে আবার ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)