সাতক্ষীরায় করোনাকালে ৪ হাজারের বেশি বাল্যবিয়ে
সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকার সময়ে বাল্যবিয়ের কারণে ঝরে গেছে বহু শিক্ষার্থী। জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ২৫০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯০ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। সাতক্ষীরা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি জানায়, মাধ্যমিকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। সেই হিসাব অনুযায়ী জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় বাল্যবিয়ের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। তবে সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা অনেক কম।
সাতক্ষীরা জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৩১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২১৪টি মাদ্রাসা, ১১টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ৫৮টি কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৮ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানের সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণির অনেক ছাত্রী অনুপস্থিত রয়েছে। শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতির তথ্য অনুযায়ী ৫৪০ ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।
তবে সাতক্ষীরা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির প্রশাসনিক প্রধান মো. সাকিবুর রহমান বলেন, ‘সাতক্ষীরা সদরের কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে করোনাকালে ৫৭৬ জনের মধ্যে এক থেকে দেড়শ’ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে ঝরে গেছে প্রায় ১০০ জন। এ ছাড়া আলিপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে করোনাকালে শতাধিক, আলিপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২৭ জনের অধিক, ঘোনা ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩০-এর অধিক, ডিবি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২৫-এর অধিক, মাহমুদপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ১৮ জনের অধিক, তালা উপজেলার কবি নজরুল বিদ্যাপীঠে ৩৭ জনের অধিক, সরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০ জনের অধিক, ধানদিয়া ইউনিয়নের শার্শা দাখিল মাদ্রাসায় ৩০ ছাত্রীর বাল্যবিয়ের তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। ২০২১ সালে সাতক্ষীরায় ১৭৭টি বাল্যবিবাহ আটকানো গেছে। মাধ্যমিক স্কুলের গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মাদ্রাসায়ও একই চিত্র। সেই হিসাব অনুযায়ী জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় বাল্যবিয়ের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাল্যবিয়ের কারণে ঝরে পড়ার হার ছিল ১০ থেকে ১৫%, কিন্তু করোনাকালে সেই হার ৪০%। অনেকে বিয়ের পর লেখা পড়া করে। জেলা প্রশাসনের আয়োজিত কর্মশালায় জেলায় বাল্যবিয়ের হার ৭৭.৭% উপস্থাপন করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রদের পড়ালেখার আগ্রহ কমে গেছে। তারা কর্মমুখী হয়ে গেছে। অনেক ছাত্র স্কুলে যায় না, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এর কারণ হচ্ছে মেয়েদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়, ছেলেদের উপবৃত্তি দেওয়া হয় না। ছেলেদের দিয়ে আয় করার সুযোগ থাকে দ্রুত, সেজন্য ছেলেদের লেখাপড়ার হার কমে যাচ্ছে।’
এদিকে, গত ২৯ মার্চ সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ও জেলা প্রশাসন আয়োজিত ‘বাল্যবিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও প্রতিরোধ কমিটির করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়, সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ে ৭৭.৭%। অন্যদিকে, পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালের বাল্যবিয়ের হার ২৯% দেখানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ইউনিসেফ সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়কারী শেখ মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ‘সাতক্ষীরা জেলার ২০১৯ সালের একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী জেলায় বাল্যবিবাহ ৭৭.৭% দেখানো হয়েছে। আমি সেটি উপস্থাপন করেছি।’
বেসরকারি সংস্থা ‘অগ্রগতি’র নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সবুর বিশ্বাস বলেন, ‘করোনাকালে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা একটি জরিপ চালিয়েছি। সাতক্ষীরা সদর, তালা, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলার ৪৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০ হাজার ৩১৮ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে জরিপ চালানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪ হাজার ৬০৪ জন ছেলে এবং ৫ হাজার ৭১৪ বালিকা ছিল। এর মধ্যে সম্মিলিত বিদ্যালয়গুলোতে ঝরে পড়ার হার ১.৮০%, বালিকা বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার ৯.৮০ এবং মাদ্রাসার ঝরে পড়ার হার ৬.৬৪%। বাল্যবিয়ের হার মাদ্রাসাগুলোতে ১৩.২৯%, বালিকা বিদ্যালয়ে ১২.৪০% এবং সম্মিলিত বিদ্যালয়ে ৯.৬৭%। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ঝরে পড়ার হার ২.১৭%, সপ্তম শ্রেণিতে ৩.১৯%, অষ্টম শ্রেণিতে ৪.৫৭%, নবম শ্রেণিতে ৫.০৭ % এবং এসএসসিতে ২.৬৯%।’
তিনি আরও জানান, কালিগঞ্জ উপজেলার একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ২৫০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯০ জনেরই বিয়ে হয়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতক্ষীরা সদরের কয়েকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘করোনাকালে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে অভিভাবকরা মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিটি মাধ্যমিক স্কুলের গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া থেকে ঝরে গেছে।’
জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার সাত উপজেলায় ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৯, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে ৮, এপ্রিলে ৪, মে মাসে ৭, জুনে ৭, জুলাইয়ে ১২ ও আগস্টে ৩০টি, সেপ্টেম্বরে ১৯, অক্টোবরে ২১, নভেম্বরে ১৪, ডিসেম্বরে ১৬, জানুয়ারিতে ১১ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৮ বাল্যবিয়ে বন্ধসহ ১৭৭ কিশোরীকে বিয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে জেলা প্রশাসন ও জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি। এসব কিশোরীর বেশির ভাগ সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির।
সাতক্ষীরা জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের প্রোগ্রাম অফিসার ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, ‘২০২১ সালে আমরা ১৭৭ কিশোরীকে বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছি। আমার যে কয়টির খবর পাই সেগুলো বন্ধ করতে পারি। বাল্যবিয়ে অনেক বেশি হচ্ছে।’
বাল্যবিয়ের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়েছে। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে বাল্যবিয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। অনেক অভিভাবক বলেন, তাদের মেয়েরা পড়াশোনায় ভালো না, দারিদ্র্যের কারণে গৃহশিক্ষক রাখতে পারেন না। অনেক অভিভাবক বলছেন, “মেয়ে প্রেম করে চলে যাচ্ছে, আমরা তো বিয়ে দিচ্ছি না। অনেকে মেয়েদের পেছনে লাগে, তাই বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।” বাল্যবিয়ের কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বহুবিবাহ বাড়ছে তালাকও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সবার সচেতনা ছাড়া বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব না।’
সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘করোনাকালে সাতক্ষীরায় বাল্যবিয়ের হার কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জরিপ করে পেয়েছি, ৫৪০ জন শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০৬ জন তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকরা রিপোর্ট দিয়েছেন, অনুপস্থিত মানে বিয়ে। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তারা অন্য স্কুলে গেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা কারিগরিতে গেছে, কেউ মাদ্রাসায় গেছে আবার অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী, কওমি ও হেফজখানায় ভর্তি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে অন্য এলাকায় কাজের জন্য গিয়ে পরে আবারও ফিরে এসেছে। এত অধিক ঝরা পড়া বলা হবে না। আমি বলবো, করোনাকালে ১২% শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এর বেশি কখনও হবে না। তবে বাল্যবিয়ের কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাল্যবিয়ের হার কমাতে হলে ইউনিয়নগুলোর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিকে আরও সক্রিয় হতে হবে। একা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা সম্ভব না। আমরা অনেক বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দিলে সেই পরিবার মেয়েকে অন্য এলাকায় নিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। সবার সচেতনতা ছাড়া বাল্যবিয়ে বন্ধ সম্ভব না।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)