আগুনে পুড়ে মুহূর্তেই শেষ পরিবারগুলো
দুই সন্তান আয়ান (৮) ও আয়াতকে (৬) নিয়ে বেইলি রোড এলাকায় বসবাস করতেন নাজিয়া আক্তার (৩১)। তাঁর স্বামী মো. আশিক পেশায় ব্যবসায়ী।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ব্যবসার কাজে বনানীতে যান আশিক। আর নাজিয়া দুই সন্তানকে নিয়ে বেইলি রোডে ভবনের তৃতীয় তলার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে যান। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বামীকে ফোন দিয়ে বলেন তাঁরা বিপদে আছেন।
নিহত নাজিয়ার আত্মীয় রিফাত হোসেন জানান, ঘটনার সময় তিনি ওই ভবনের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ভবনটির নিচতলায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পান। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরে তৃতীয় সিঁড়ি থেকে আয়ানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগুনে মারা গেছেন নাজিয়া এবং আয়াতও। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে তাঁদের মরদেহ রাখা হয়েছে।
ভাগনে সান রায় (১০) ও ভাগনি সম্পূর্ণা রায়কে (১২) বৃহস্পতিবার স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন মামা পীযূষ পোদ্দার। স্কুল শেষে আবার বিকেলে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন তিনি। সন্ধ্যায় মা পপি রায়ের সঙ্গে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় খেতে যায় তারা। আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন তারা তিনজনই। মুহূর্তেই একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গের সামনে গিয়ে দেখা যায়, চিৎকার করে করছিলেন পীযূষ পোদ্দার। তিনি জানান, ভাগনি সম্পূর্ণা পড়ত সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আর সান রায় পড়ত উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণিতে। মা–বাবার সঙ্গে মালিবাগে থাকত তারা।
তিনি আরও জানান, রেস্তোরাঁয় আগুন লাগার খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে চলে যান। এসে দেখেন দাউ দাউ করে রেস্তোরাঁ জ্বলছে। কিন্তু কোথাও পপি, সম্পূর্ণ ও সানের খোঁজ পাননি। এরপর মধ্যরাতে ছুটে এসেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। সম্পূর্ণা ও সানের মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু পপির কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না।
‘আমাকে বাঁচাও, আমি আটকা পড়েছি’, বাবাকে শেষ কথা নিমুর
বেইলি রোডের রেস্তোরাঁয় বান্ধবী আর তুতো বোনদের নিয়ে খেতে গিয়েছিল নিমু। ভবনে আগুন লাগলে তারা ছয়জন ভেতরে আটকা পড়ে। আগুন যখন নিচ থেকে ওপরের দিকে ক্রমশ তীব্র হচ্ছিল, তখন ১৮ বছর বয়সি নিমু ফোন করেন তার বাবাকে। বাঁচার আকুতি জানিয়ে নিমু তার বাবাকে বলেন, ‘বাবা, আমাকে বাঁচাও, আমি আটকে পড়েছি।’
এর কিছুক্ষণ পরই বন্ধ হয়ে যায় নিমুর মোবাইল ফোন। বাবা আবদুল কুদ্দুস দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে জানতে পারেন, তার মেয়ের মরদেহ ইতোমধ্যেই নেয়া হয়ে গিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
আবদুল কুদ্দুস ভারাক্রান্ত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে মেয়ের জন্য আহাজারি করে বলেন, ‘মেয়েটা মৃত্যুর সময় বারবার বাবা বলে চিৎকার দিয়েছিল।’ নিমু তার খালাতো বোন আলিশা ও রিয়াসহ পাশের বাসার আরও তিনজন বান্ধবীর সঙ্গে ভবনটির একটি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল। তারা ছয়জনই আগুনে মারা গেছেন বলে জানান আলিশার মামা।
কাচ্চি খেতে গিয়ে প্রাণ গেছে মেয়েসহ ভিকারুননিসার শিক্ষিকার
রাজধানীর বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুনের ঘটনায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা লুৎফুর নাহার করিম (৪৭) ও তার মেয়ে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতি তাজরিন (২৩) নিহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে স্ত্রী ও মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করেন এম. এ. এইচ গোলাম মহিউদ্দিন।
বিলাপ করতে করতে তিনি জানান, তার স্ত্রী দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলেন। দাঁত দেখাতে হাসপাতালে যান মেয়েকে নিয়ে। ফেরার পথে কাচ্চি খেয়ে আসার পরামর্শ দেন মহিউদ্দিনই। এখন স্ত্রী-মেয়ের মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করছেন।
এদিকে শিক্ষিকা ও তার মেয়ের মৃত্যুতে ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পক্ষ থেকে শোকবার্তায় বলা হয়, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, অত্র প্রতিষ্ঠানের মূল প্রভাতি (৭ম-১০ম) শাখার সিনিয়র শিক্ষক লুৎফুন নাহার করিম (লাকী) ও তার মেয়ে অত্র প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্রী জান্নাতিন তাজরী গতকাল রাতে রাতে বেইলী রোডের অগ্নিদুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন।(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
তাদের মৃত্যুতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের গভর্নিং বডির সব সদস্য, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শোকাহত। আমরা তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা এবং সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি। পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল আল্লাহতাআলা তাদের জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আজ শুক্রবার বাদ জুমা দুপুর ২টায় ভিকারুননিসার মূল শাখার কলেজ মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
যাওয়ার কথা ছিল ইতালিতে, লাশ হলেন একই পরিবারের ৫ সদস্য
রাজধানীর বেইলি রোডের সাততলা ভবনে আগুনের ঘটনায় ইতালি প্রবাসী সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউসারসহ (৪২) একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই সপ্তাহ খানেক পরই ইতালি চলে যাওয়ার কথা। তিনদিন আগেই পরিবারের প্রত্যেকের ভিসা মিলেছে।
শুক্রবার (১ মার্চ) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান নিহতের স্বজন মোস্তাফিজুর রহমান শাহীন।
তিনি বলেন, কাউসার দীর্ঘদিন ধরে ইতালিতে থাকতেন। এক মাস আগে দেশে এসেছিলেন পরিবারকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সপ্তাহ খানেক পরেই ওনাদের ইতালি চলে যাওয়ার কথা। এর আগে সপরিবারে এসেছিলেন রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করতে।
নিহতের এই স্বজন বলেন, তিনদিন আগেই পরিবারের ভিসা মিলেছে। সেই উপলক্ষ্যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেয়ে-দেয়ে একটু আনন্দ করতে এসেছিলেন।
শাহীন বলেন, রাত ৮টার দিকে সৈয়দ মোবারক তার স্ত্রী স্বপ্না (৩৮), মেয়ে সৈয়দা তাশফিয়া (১৭), সৈয়দা নূর (১৫) ছেলে সৈয়দ আব্দুল্লাহকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন কাচ্চি ভাইতে খাওয়ার জন্য। তারা সেখানে পৌঁছানোর পর এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তারা সবাই মারা যান।
জানা গেছে, প্রবাসী মোবারকের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামে। তিনি ঢাকার মগবাজার এলাকায় থাকতেন।
এর আগে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুন লাগার সংবাদ পায় ফায়ার সার্ভিস। এতে অন্তত ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া, গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল রাতে বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে, সেটি সাততলা। ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলায় একটি পোশাকের দোকান ছাড়া ওপরের তলাগুলোতেও রয়েছে খাবারের দোকান। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে খাবারের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় হয়। অনেকেই পরিবার নিয়ে সেখানে খেতে যান।
তিনতলায় ছিল কাপড়ের দোকান। বাকি সব ছিল রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টগুলোতে ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। যে কারণে আগুনের তীব্রতা ছড়িয়েছে ভয়াবহভাবে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)