“হারিয়েছি তাঁকে অনন্তকালের তরে, বেদনায় ফাটে বুক
ডুকরে ডুকরে কাঁদে মন, হরণ করেছে সুখ।”
মায়াজাল গড়তে বহুকাল পার করতে হয়, কিন্তু সেটা যখন চারপাশটা আগলে রাখতে শুরু করে পরম মমতায়-একান্ত আপন করে, বিপত্তি ঘটে তখনি। জাল ছিঁড়ে হারিয়ে যায় অজানা গন্তবের পানে, সবাইকে পর করে, হৃদয়ে একটা বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করে। নিঃস্বতা, রিক্ততা আর শুন্যতা কাটিয়ে উঠার জন্য হাহাকার করে মনটা, কাছে পাওয়ার ব্যাকুলতায়।
সময়ের ব্যবধিতে ৫ বছর পার হচ্ছে আজ (২৪ জুলাই ২০২০ইং), ব্যবধি বছরে হলেও আপেক্ষিক ভাবে ৫ সেকেন্ডও মনে হচ্ছে না তিনি যে শুন্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তিনি গণিতের ছন্দময় সুর তোলা শিল্পস্রস্টা, ছন্দের দ্যোতনায় পেন্সিলের খসখসে শব্দ যেন মুহূর্তের মধ্যে ইন্দ্রজাল তৈরি হতো যার ছোঁয়ায়, তিনি মোঃ আব্দুল গফফার খান- আমাদের সবার গফফার স্যার। তাঁর হাতের ছোঁয়া পেয়ে, সান্নিধ্য পেয়ে আজ কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, আবার কেউবা অন্যান্য পেশায় যারা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন, বলেছেন জীবনদর্শনের কথা, দিয়েছেন সঠিক পথের নির্দেশনা, শিখিয়েছেন নিজস্বতাকে চিনতে, দেখিয়েছেন বড় হওয়ার পথ-যে পথে আমাদেরকে চলতে দেখবেন আর লেন্স পরে দেখবেন দৃষ্টিসীমার বাইরে গেলে। কিন্তু তিনি এখন আমাদেরকে দেখছেন সপ্তর্ষি হয়ে, লেন্স না লাগিয়ে। জীবনমুখী আর বাস্তব ধর্মী অনেক কথা বলতেন পড়ানোর সময়। সম সাময়িক সমাজচেতনা, সাহিত্য, দর্শন ধারণ করতেন চিত্ত দিয়ে। অঙ্কের পাশাপাশি জীবনকে চিনতে শেখাতেন। পদার্থ বিজ্ঞানের অপদার্থ, রসায়ন বিজ্ঞান রসহীন আর জীব বিজ্ঞানের নির্জীব বিষয়গুলি নিমিষেই কেমন সার্থক হয়ে উঠত। এক কথায় অল ইন ওয়ান- যেন আস্ত প্যাকেজ। তিনি গফফার স্যার থেকে হয়ে উঠেছিলেন বিশাল এক প্রতিষ্ঠান। এমন প্রতিভা, সাহিত্যানুরাগী, দর্শন-জ্ঞান সম্পন্ন, নির্ভেজাল, নির্লোভী, পরোপকারী মানুষকে আর কোথাও দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি এখনো। নিঃস্বার্থে যে একজন মানুষ তাঁর সবকিছুকে উজাড় করে দিতে পারেন তা উনাকে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
একজন কুমার মাটি থেকে কাদা করে তাই দিয়ে যেভাবে মৃৎশিল্প চর্চা করেন একান্ত আপন করে নরম ছোঁয়ায়, আলতো করে ঠিক তেমনি আমাকেও তৈরি করেছেন একইভাবে, পরম মমতায় আর হয়ে উঠেছি জীবন্ত মৃৎশিল্প। কুঁড়েঘর থেকে আজকে “আমি” হওয়ার পিছনে বাবা-মায়ের পরে যে মানুষটাকে সবথেকে কাছে পেয়েছি তিনি গফফার স্যার, তিনি আমার বন্ধু, আমার পথ প্রদর্শক, মাথার উপর বিশাল ছাতা। তাঁকে হারানোর সাথে সাথে খেয়েছি বিশাল ধাক্কা, ঢাকা থেকে যাওয়ার পর যখন গাড়ি থেকে নামি, মনে হয় সেই ছাতা কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে আর পায়ের নিচ থেকে সরিয়েছে মাটি।
সদা প্রফুল্ল, হাস্যোজ্জ্বল মহান মানুষটার বিদায় যেন আজও মন মানতে চায় না। সেদিন তাঁর শির ধারে বসে অপলক দৃষ্টিতে অশ্রুপাত বিসর্জন পূর্বক বক্ষের দুরুদুরু কেঁপে উঠার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলাম। মনে সাই দিচ্ছিল না যে তিনি আর ফিরবেন না। এমন নির্লোভী আর নিবেদিত প্রাণ মানুষকে হারিয়ে অন্তরাত্মা গুমরে গুমরে কাঁদে।
একজন শিক্ষকের মহান থেকে মহান হয়ে উঠার পিছনের গল্প অল্প কথায় সারা যায়না। সব শিক্ষকই শিক্ষক হয়েই চলে যান অজানা দেশে, কিন্তু কিছু শিক্ষক সব কিছুকে ছাড়িয়ে যান কীর্তিমান হয়ে, পরম পূজনীয় হয়ে। কিছু কিছু ফুল আছে, সৌরভ ছড়াতে থাকে ঝরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। আবার নতুন ভাবে ফুটে, চলতে থাকে তার প্রকৃতিপনা। “আমি” হয়ে উঠার পিছনে আরও অনেক শিক্ষক আছেন তাঁদেরকেও স্মরণ করছি আজ। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এমন লাখো-কোটি গফফার স্যার আছেন যাঁদের জন্য পৃথিবী চলছে কবিতার ছন্দে, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেইসব মানুষদেরকেও।
আজ মহাত্মা গফফার স্যার নেই, রেখে গেছেন অগণিত ছাত্র-ছাত্রী, শুভাকাঙ্ক্ষী যারা প্রতিটা মুহূর্তকে জিয়ন কাঠির মত আঁকড়ে আছে। আপনি থাকবেন স্যার ঐ দূরাকাশের তারা হয়ে অনন্তকাল ধরে।
বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো স্যার…।
লেখক :
ইমামুল হোসেন
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার
নাজদাক টেকনোলজিস লিমিটেড
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]