হ্যালো প্রিয় পাঠক, আমি মোহাম্মদ কবির খান, সভাপতি ফ্রেন্ড সার্কেল ২০০৪। চন্দনপুর, কলারোয়া, সাতক্ষীরা। ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে জব করি যা স্যালারি পাই, তা দিয়ে ছোট্ট পরিবার নিয়ে কোন রকম আছি। মাস শেষে বাদ দিয়ে হাতে আর তেমন কিছুই থাকে না, যা দ্বারা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করব। মাঝে মাঝে ভাবি এইযে এত এত লেখাপড়া করলাম, কি কাজে লাগলো। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সন্তান, গ্রাম থেকে উঠে এসেছি, মামা খালুর জোর না থাকায়, ভালো রেজাল্ট করা সত্য একটা সরকারি চাকরি কপালে জোটাতে পারলাম না। এই তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও, আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।
আমার স্ত্রীর কথায় সমিত ফিরে -,গোছ- গাছ করতে লাগলাম। আগামীকাল সকাল সাতটায় গাড়ি, গ্রামের বাড়িতে যাব ঈদ উদযাপন করতে, গ্রামে পরিবার-পরিজন সহ, আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সকল বন্ধুরা আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে। এবার ঈদ ফ্রেন্ড সার্কেল দু হাজার চারের পক্ষ থেকে,গরিব অসহায় কিছু বাচ্চাদের নতুন জামা কাপড় দেয়া হবে। আর সেই কাপড় কেনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার যে কি জ্বালা তা ভুক্তভোগী মাত্র ভালোই জানেন, কল্যাণপুর থেকে বাসে উঠে, ঢাকার জ্যাম পার হয়ে এসে, বাস আটকা পড়ল আইসা ফ্রি গেটের জামে। অনেক লম্বা লাইন সময় লাগবে, তবে কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হবে তা বলা যায় না।
আমার ছয় মাসের দেয়া মামণিটা আবারো খুব দুষ্টু হয়ে উঠেছে, এতক্ষণ তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু হাকারদের চেঁচামেচিতে উঠে কান্না জুড়ে দিল, ভাই ওকে থামাতেই নিজের হাত পায় একটু নাড়াতে বাইরে নামলাম। একটু বাদে গাড়ি ছাড়লো, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে গাড়ি আবার থামল। তবে এবার প্রায় খাটের নিকটে এসে গেছি। আর এখানেই বিপত্তি, কারণ ঘাটের নিকটেই হকারদের উৎপাত বেশি। বিষয়টা যারা আরিচা ফেরিঘাট হয়ে ঢাকায় যাতায়াত করেন, ভালো করেই জানেন, গাড়ির সুপারভাইজার এখানে কাউকে নামতে নিষেধ করল, কারণ যে কোন মুহূর্তে গাড়ি সিরিয়াল পেতে পারে। অগত্যা আর কি করা, মেয়ের সাথে খুনসুটি আর হকারদের উৎপাত গাড়ি ফেরিতে ওঠার --। এমন সময় একজন হকারের ব্যতিক্রমধর্মী কথাই, চারদিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হল, দেখলাম আমার বয়সী একটি ছেলে, একেবারে অফিসিয়াল ড্রেস, কালো প্যান্ট, কালো সু, নীল রংয়ের টাই, গ্রামীন চেকের টি-শার্ট, ব্যাক ব্রাশ করার চুল, গায়ের রং শ্যামলা, কিন্তু সত্যিকারের হ্যান্ডসাম যুবক --। চোখটি যেভাবে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল, "সম্মানিত যাত্রীগণ আসসালামু আলাইকুম, আপনাদের যাত্রা শুভ হোক "প্রিয়জনের সাথে ঈদ হয়ে উঠুক আনন্দময়, আমি ইমরুল কায়েফ, অন্য হকারদের মত আমিও একজন হকার, হয়তোবা আমার পোষাক-আশাক দেখে আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি মাত্র ২ মিনিট আপনাদেরকে বিরক্ত করে চলে যাব, দোষত্রুটি নিজে গুনে মার্জনা করে দিবেন। সম্মানিত যাত্রীগণ দূরপাল্লার যাত্রা পথে নিজ মালামাল সাবধানে রাখবেন, অপরিচিত লোকের দেওয়া কোন কিছু খাবেন না? পারলে জাগ্রত থাকার চেষ্টা করবেন? কারণ সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি? প্রিয় যাত্রীগণ এবার একটু নিজের কথা বলব, আমিও একদিন বেকার ছিলাম, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে, একটি চাকরির জন্য অনেক দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু মামা খালুর জোর না থাকায়।
কোনখানে স্থান পায়নি, যদিও বা দুই এক জায়গায় সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু চাই অভিজ্ঞতা, ছাত্র জীবনে কর্মের অভিজ্ঞতা পাব কোথায় বলুন, তাছাড়া গরীব বাবা টাকায় কেনা স্যান্ডেল আর কত জোড়া ক্ষয় করা যায়। অবশেষে পরিবারের নির্ধারণ অর্থ কষ্ট আর বৃদ্ধ পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে এই পথ বেছে নিলাম, বাবার শেষ সোমবার ১০ কাঠা জমি বিক্রয় করে, চাকুরী নিয়ে ঘুষখোর অফিসার হওয়ার চেয়ে, একজন রাস্তার হকার হওয়া অনেক বেশি সম্মানের নয় কি? প্রশ্ন ছুড়ে দিল যাত্রীদের উদ্দেশ্যে! যুবকটির কাজে শান্তি নিকেতনে ঝুলানো ব্যাগে,অনেক ধরনের বই,ম্যাগাজিন, কলম এবং পেন্সিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্ভবত এবার আসছে তার পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় গাড়ির বাস বরাবর সিটের এক যাত্রী গায়ে পাঞ্জাবি চেহারা সুরত বা ভাব সব দেখে মনে হয় কোন থানা বা জেলা পর্যায়ের নেতা হবে হয়তো? যুবকটিকে ধমক দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে বললেন, কিন্তু তার কথায় রুমে না গিয়ে, সে প্রতি উত্তর দিল, তাতে নেতাই বরং জমে গেল। যুবকটি কি উত্তর দিল শুনুন, এই যে মিস্টার আপনাকে দেখতে তো নেতা নেতা বলেই মনে হচ্ছে? তাব ভোটের সময় মাইকে গলা ফাটিয়ে যখন ভোট ভিক্ষা চান, তখন মাইকের দম ফাটানো আজ আমজনতার সমস্যা হয় না? সমস্যা হয় যখন আমজনতা বা বেকার যুবকরা --,মোটা ভাত -কাপড়ের আশায় হকার হয় তখন না? লজ্জা করে না আপনাদের। লোকটা বোধহয় দক্ষিণবঙ্গের কোন থানা বা জেলা পর্যায়ের নেতাই হবে, যুবক হকার টির কথায় প্রতি উত্তর না অন্য কিছু করতে গেলে জনরোসে পড়তে হতে পারে,বা অহেতুক ঝামেলার ভয়ে চুপ হয়ে গেলেন।
এবার অনেকেই তার নিকট হতে বই বা ম্যাগাজিন নিল। আমি আমার মামনির জন্য জন্য দুইটা ছবির বই ও একটি ঈদ ম্যাগাজিন নিলাম, টাকাটা দেওয়ার সময় ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, আপনি একজন গর্বিত হকার! আপনাকে দেখে বেকার যুবকদের বিশেষ করে শিক্ষিত যুবসমাজকে শিক্ষা নেওয়া উচিত? ছেলেটি আমাকে অতি উত্তরে ধন্যবাদ দিয়ে, আবারো যাত্রীদের নিকট ভুলক্রোটি ক্ষমা চেয়ে দ্রুত নেমে গেল। এই যুবকটির কথা ভুলতে পারছিলাম না, তাই আজ ২৯ রোজায় ফ্রেন্ড সার্কেলের ইফতার মাহফিলও গরিব অসহায় বাচ্চাদের নতুন কাপড় বিতরণ অনুষ্ঠানে ওই ব্যতিক্রমধর্মী হকারের কথা কথা শেয়ার করে বললাম, "আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে, কথাই না বড় হয়ে কাজে বড় হবে "।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]