প্রিয় পাঠক আমি ইচ্ছে করলে , এই গল্প টিনাদের বাড়ির গেটের সামনে শেষ করতে পারতাম, কিন্তু কেন মনে হল, কোথায় জানি অপূর্ণতা থেকে যাচ্ছে। তাই দ্বিতীয় অংশে আপনাদের নিয়ে আসলাম। কথায় বলে কাচ ভাঙলে জোড়া লাগে, কিন্তু মন ভাঙলে জোড়া লাগে না। ৩৫ তম বি,সি,এস এ অংশগ্রহণ করে রায়হান কবির আজ উপ-সচিব। প্রশাসন ও জনকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে তার পোস্টিং। আজ তিন বছর হতে চলেছে চাকরির বয়স। ছোট ভাই বোনদের ঢাকায় এনে ভর্তি করিয়েছে, সরকারি কোয়াটার আছে, গাড়ি ড্রাইভার সবি আছে। কিন্তু মনের অপূর্ণতা --আজও রয়ে গেছে; গ্রামের বাড়ি হতে বাবা-মা ঘন ঘন চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য, ভালো ঘর ভালো মেয়ে দেখছে তারা, কিন্তু কবির এটা সেটা বলে কাটিয়ে দিচ্ছে, মাঝে বোনটারও ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। এখন মা বাবা আর কোন অজুহাত শুনতে রাজি নয়, এমন কি সে দিন মা --,ফোনে বলে বসলো; খোকা, তোর কোন পছন্দ থাকলে বল। তুই তো আজকালকার ছেলে, বাবার সাথে না বলিস, আমার সাথে বল। পৃথিবীতে সব অপরাধের বিচার আছে, কিন্তু মন ভাঙার অপরাধের কোন বিচার নেই। কবির তার নিজের ক্ষেত্রে টিনা কেউ দোষ দিতে পারে না,আবার না পারছে তাকে ভুলতে -- দীর্ঘ তিন বছরের মধুর সম্পর্কের নানা স্মৃতি অবসরে মস্তিষ্কে ভেসে বেড়ায়। না এবার একটা সিদ্ধান্ত তাকে নিতেই হবে। মাকে আর কত মিথ্যা বলবে? এমন ভাবনার খেলা মাথায় নিয়ে পরদিন অফিসে যেয়েই শুনলো, পাবনার নারী কল্যাণএন,জি ওর একটি প্রোগ্রামে, তাকে অফিস থেকে সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রধান অতিথি হিসেবে পাঠানো হচ্ছে, সাথে আরো দুইজন সরকারি কর্মকর্তা যাবেন, দুই দিনের সফর। সেই মোতাবেক আগামীকাল অফিস টাইমে রওনা হতে হবে। অনুষ্ঠানে স্থল পাবনা নারী কল্যাণ এনজিওর হল রুম। অতিথি রুমে বসে আছেন, উপ-সচিব রায়হান কবির সহ অন্যান্য অতিথি বৃন্দ। পরস্পর সবাই মত বিনিময় করছেন। দু - দশ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হবে। এমন সময় হল রুম থেকে মাইকে এলাউন্স হল একটি পুরুষ কণ্ঠে, সম্মানিত উপস্থিতি আরেকটু বাদেই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে আনুষ্ঠানিকভাবে,তো আজকের এই অনুষ্ঠান, এখনকার পর্ব যিনি পরিচালনা করবেন, আমি তার নাম ঘোষণা করছি, তিনি হলেন আমাদের এন জি ওর পাবনা জেলা কো- অর্ডিনেটর মিস শায়লা শারমিন টিনা, আমি তাকে মঞ্চে এসে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান উপসচিব রায়হান কবীরের কর্ণে টিনা নামটি কর্ণ গোচর হতেই হৃদয়টা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো, ঠিক যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগার মত। মুহূর্তে অতীতের চলে গেল রায়হান কবির।না, না এসব আমি কি ভাবছি, একই নামে তো অন্য কেউ ও হতে পারে। তাছাড়া টিনার তো এতদিন স্বামি সন্তান নিয়ে সুখে ঘর করার কথা? তাছাড়া বড়লোক বাপের আদরের কন্যা,কুটো টা কেটে ও জীবনে তাকে দু টুকরো করতে হয়নি?সে করবে চাকরি! ধ্যান ভাঙল সহকর্মীর কথায়, স্যার --প্রস্তুতি নিন, আর এই নিন আপনার বক্তব্যের কপি। ঠিক, একই রূপে কো অর্ডিনেটর শায়লা শারমিন টিনা মঞ্চে এলে তার হাতে অতিথি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে মঞ্চ থেকে সরে গেল পুরুষ কর্মী টি। টিনা একে একে অতিথিদের নাম ধরে মঞ্চে আসার আহ্বান জানাতে থাকলো। সর্বশেষ প্রধান অতিথির নাম ঘোষণা করতে যেয়ে, মুহূর্তে যেন থমকে গেল ;কে এই রায়হান কবির!তবে কি? কিছুটা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রধান অতিথির নাম ঘোষণা হতেই মঞ্চে উঠে এলেন উপসচিব রায়হান কবির।মঞ্চে উভয়ের চোখা-চোখি হতেই উভয়ের মনের ভিতর যেন একটা সাইক্লোন এর সৃষ্টি হল। যাহোক উভয়ের সামলে নিলেন, অনুষ্ঠান-পর্ব শেষে যখন উপ-সচিব বিদায় নিবেন, তখন এন জি ওর সকল কর্মকর্তা এক জায়গায় সমবেত হলেন। একে একে সবাই সালাম দিয়ে বিদায় জানাচ্ছেন, সর্বশেষ কো- অর্ডিনেটর শায়লা শারমিন টিনার পালা, টিনা কবির কে, একটু ছুয়ে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে হাতে হাত দিয়ে ছোট্ট করে বলল, আমাকে এক ঘন্টা সময় দিবে? গোধূলির লগ্ন তখন অস্তমিত হতে চলেছে, কবির ও আস্তে করে বলল, সন্ধ্যা সাতটার সময় জেলা বাংলোতে চলে আসো। আমি আজ নাইট আছি। বাংলোই ফিরে ফ্রেশ হয়ে পশ্চিমের ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারটায় বসলো রায়হান কবির।বাংলোর কর্মচারী এসে এক কাপ ধোঁমায়িত গরম কফি রেখে গেল। বেনসন সিগারেট ও লাইটার নিজের কাছেই ছিল। কফিতে এক চুমুক দিয়েই একটা বেনসন ধরালো।নিকট অতীতের নস্টালজিয়ায় তাকে পেয়ে বসলো, কি--, কি বলতে চাই টিনা? বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ আসছে, কিন্তু বেনসনের ধোয়াই তার চিন্তা গুলোর জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় একটি গাড়ির হর্ন শুনতে পেল। কবির বুঝতে পেরেছে কে এসেছে, যেন বহু কাল এই আসার অপেক্ষায় সে বসে আছে ;কর্মচারীদের বলা আছে, তাদের একজন সারের রুমটা দেখিয়ে দিল, দরজা খোলাই আছে, তারপরও ছোট্ট করে কাশি দিয়ে টিনা বলল আসতে পারি? বেলকানিতে বসা অবস্থায় - ই উত্তর দিল, অনুমতির প্রয়োজন নেই, আস।সামনে রক্ষিত চেয়ারটায় বসলো টিনা।মিনিট খানেক উভয়ে নিরব, অবশেষে নীরবতা ভেঙে টিনাই বললো, তারপর, কেমন আছো? দেখতেই তো পাচ্ছ দিব্যি ভালো আছি। আমি সে কথা জানতে চাইনি কবির?মানে তোমার বউ - বাচ্চা পরিবার ---, টিনা কথা শেষ করতে পারল না, তার আগেই কবির শুষ্ক হাসি হেসে বলল, একই কথা যদি আমি জানতে চাই ---? টিনা, না আগে তুমি বলো। না টিনা, আগে তোমার কথা জানতে চাই? ও তার আগে বল, কি খাবে চা না কফি?এক গ্লাস ঠান্ডা পানি। ওকে টিনা, কলিংবেল চাপ দিতেই একজন কর্মচারী আসলো। পানি পান করার পরে বলতে শুরু করলো টিনা, তুমি যখন ক্রমাগত অ্যাভয়েড করে চলেছ তখন বাড়ির দিকে প্রচন্ড চাপ, এক সময় তোমার ওপরে বিরক্ত হয়েই অভিমান করে বিয়েতে রাজি হই, কিন্তু কপাল মন্দ, তাই সানাইয়ের শুর শেষ হওয়ার আগেই, বরযাত্রীর গাড়ি রোড এক্সিডেন্ট করে, কয়েকজন মারাও যান তার মধ্যে আমার হবু স্বামীও ছিলেন! অপবাদ জুটে গেল কপালে, বরপক্ষ পড়ে মরুক নিজের পরিবারের লোকও যেন পর হয়ে গেল এমনকি অনেকে পর মনে করতেও লাগলো। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম ---।একটা সময় সুস্থ হলাম বটে, তবে ডাক্তার স্থান পরিবর্তন করার কথা বললেন, ঠিক ওই মুহূর্তে এন জি ওর সার্কুলার দেখতে পায় এবং এপ্লাই করি আর চাকরিটাও কেন জানি হয়ে যায়। পোস্টিং হয় এখানে সেই থেকে এখানেই আছি, মাঝে মাঝে ঢাকাতে যাই বাবা মাকে দেখে আসি, ছোট ভাইটা সময় পেলে আমার এখানে আসে। অসহায় মহিলাদের নিয়ে ভালোই আছি কি বলো ----? এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে কথা শুনছিল কবির! এবার তোমার কথা বল কবির।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে -----, আমার কথা কি আর বলবো, এইতো ভালোই আছি। অভিমানটা এখনো আছে দেখছি তোমার। কবির,প্লিজ হিয়ালি করো না, শোনো তাহলে টিনা--,তোমার আর আমার পরিবারের ক্রমাগত চাপে দিশেহারা হয়ে এক পর্যায়ে প্রথমে মেস বদল করি,তারপর সিম বদলানোর সিদ্ধান্ত নিই,যেদিন সিম বদলায় তার আগের রাত বারোটার সময় তোমার শেষ মেসেজ ছিল, আজ হতে তোমার সাথে আমার "ব্রেকআপ " জানো, সেদিন রাতে আমি অনেক কেঁদেছিলাম। তারপর কবির?নিজেকে সামলে নিতে কয়েকদিন সময় লাগলো। এরপর কবির, চাকুরি পাওয়া থেকে শুরু করে, টিনার বাড়ির গেট পর্যন্ত ছুটে যাওয়া এবং সর্বশেষ উপ-সচিব হওয়া পর্যন্ত বলল। জানো টিনা? কখনো ভাবি নি যে তোমার সাথে আর দেখা হবে।যখন একা থাকি তখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে, আর একটা বেনসন ধারালো কবির।ধূমপানের অভ্যাসটা মনে হয় বেড়েছে? তা বলতে পারো, একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে আর কি আছে? আজ অনেক গরম, মনে হয় বৃষ্টি হবে, দেখো পশ্চিম আকাশে কেমন মেঘ জমেছে, হা কবির,বৃষ্টি হলে যেমন আকাশ পরিস্কার হয়, ধরণী শান্ত হয়ে যায়, তেমনি আজ আমাদের মনের আকাশের কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে সবকিছু ধুয়ে মুছে দিয়ে যাক, তুমি কি সেটা চাও না? অবশ্যই চাই, এই বলে কবির আস্তে আস্তে উঠে টিনার পিছে দাঁড়িয়ে তার দুই কাঁধে হাত রেখে, কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, তা হলে আজ হতে আমাদের "ব্রেকআপ "ভেঙে নতুন চলার পথ সৃষ্টি হল কি বলো? টিনা আর থাকতে না পেরে কবিরের বুকে মাথা রেখে দু হাতে গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। শক্ত করে ধরে রেখো কবির,আর কখনো ছেড়ো না যেন -----! এই জানো কবির? কি? কবি গুরুর সেই গানের কথা খুব মনে পড়ছে " সে দিন দুজনে দুলে ছিনু বনে" এই দেখ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল -- চলো না ছাদে যেয়ে ভিজি----? এখন ভিজলে কাল থেকে আর কারোর চাকরি থাকব---? দুষ্টু কোথাকার। ঈদের ছুটিতে এবার আমরা হা----- যাচ্ছি কিন্তু, উভয়ে হা: হাঃ হাঃ।।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]