ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মহামারী এসেছে এবং অনেক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। মহামারী বা প্যানডেমিক এর ভয়াবহতা যে কেমন হতে পারে তা আমরা সবাই মোটামুটি জানি। আজ থেকে 500-700 বছর আগেও প্লেগ এসেছিল আবার তা নিজের মতো করেই চলে গিয়েছে। সাধারণত সকল বড় ধরনের মহামারীর প্যাটার্ন গুলো এমনই হয়ে থাকে। এরা কোন একটা নির্দিষ্ট উৎস থেকে শুরু হয়ে আবার নিজেদের মতই একটা সময়ে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমান সময়ে অনেক নতুন টেকনোলজি থাকার কারণে আমরা কোভিড-১৯ ভাইরাস এর জিনগত গঠন এবং আমাদের দেহে এর রোগ সৃষ্টি করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আর এই কারনেই এর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু প্রতিষেধক তা একেবারেই নতুন তাই এটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে একটা সংশয় কাজ করছে। আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু হচ্ছে করোনার প্রতিষেধক। আমি একটা সাধারণ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব যে এই প্রতিষেধক আমাদের শরীরে কিভাবে কাজ করে। ইনশাআল্লাহ লেখাটা পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে যে প্রতিষেধক টা আপনাদের নেয়া উচিত কি না।
বর্তমানে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চার ধরনের ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয়েছে।
1. BioNTech (Germany) এর pfizer.
2. Moderna vaccine
3. Oxford এর Astrazeneca vaccine
4. Russia এর Sputnik.
Pfizer আর Moderna vaccine কে বলা হয় mRNA vaccine. এদের কাজ করার পদ্ধতি প্রায় একই রকম।
mRNA vaccine আমাদের দেহে কিভাবে কাজ করে?
mRNA অর্থাৎ messenger RNA, মানুষের দেহে একটা বার্তা বা মেসেজ নিয়ে যায়। mRNA vaccine মানুষের দেহে করোনাভাইরাস এর জিনগত গঠনের (genetic code) একটা অনুরূপ কপি নিয়ে যায় ভ্যাকসিন এর মাধ্যমে। যখনই আমাদের দেহের ইমিউন সিস্টেম এই সিন্থেটিক গঠন সম্বৃদ্ধ ভাইরাস কে চিহ্নিত করতে পারে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অনেক শক্তিশালী এন্টিবডি তৈরি করতে থাকে। বলা হয়ে থাকে প্রথম dose দেয়ার 24 থেকে 48 ঘণ্টার মধ্যে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুব সক্রিয় হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সিন্থেটিক ভাইরাস কেন আমাদের শরীরে ইনফেকশন করে না? এর কারণ হলো ভ্যাকসিন এর ভেতরে থাকা জিনগত গঠনকে খুবই দুর্বল ভাইরাসের হয়ে থাকে। যেহেতু ভ্যাকসিন টা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি তাই এটা আমাদের দেহের অন্য কোনো জিনের উপরে প্রভাব ফেলে না।
Astrazeneca vaccine আর Sputnik vaccine কে বলা DNA vaccine
DNA vaccine এর কাজ করার পদ্ধতি কি?
মূলত অন্য আরেক ধরনের ভাইরাস, যাকে আমরা বলি Adenovirus, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করা হয় এবং এর সাথে একটা ডিএনএ সংযুক্ত করা হয় যা করোনাভাইরাস এর spike প্রোটিন এর জেনেটিক কোড বহন করে। এই স্পাইক প্রোটিন কে আমরা বলতে পারি আসল কালপ্রিট। কারণ আমাদের দেহে coronavirus এই স্পাইক প্রোটিন দিয়েই ইনফেকশন করে থাকে। প্রোটিন এর বিরুদ্ধে আন্টি বডি তৈরি করতে থাকে।
সর্বোপরি আমরা বলতে পারি যে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আমাদের দেহকে করোনাভাইরাস এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং আমাদের দেহের ভেতরে থাকা সৈন্যদলকে, অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেমকে (Tcell, B Cell) শক্তিশালী এন্টি বডি বা হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলে। যাতে করে পরবর্তীতে এমন কোন ভাইরাস শরীরের ভেতরে দেখা গেলে তাকে মেরে ফেলতে পারে।
এবার আসি প্রতিষেধকের কার্যক্ষমতায়।
RNA গঠনগত দিক দিয়ে ডিএনএ এর তুলনায় অনেক ভঙ্গুর প্রকৃতির। সেই দিক বিবেচনা করলে Astrazeneca আর Sputnik বেশী কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু clinical trial এর মাধ্যমে দেখা যায় যে, Pfizer 94%, Moderna 90% আর Astrazeneca 84.2% কার্যকরী। RNA vaccine সংরক্ষন করতে অনেক নিম্ন তাপমাত্রার (-94F) প্রয়োজন হয় যা ব্যয়বহুল বলা চলে। কিন্তু Astrazeneca এর ক্ষেত্রে তেমন কোনো বিশেষ সুবিধার দরকার হয়না।
দুটি প্রতিষেধক কি FDA approved. তবে ভালো খবর হচ্ছে যে এই প্রতিষেধক গুলো নেয়ার পরে তেমন গুরুতর ভাবে কেউ অসুস্থ হয়ে নি। তবে সামান্য কিছু সমস্যা যেমন মাথাব্যথা বা টিকা দেয়ার জায়গায় ব্যথা এগুলো হতে পারে। তবে গবেষণায় দেখা যায় যে যারা আগে একবার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা গুলো একটু বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু এই সার্ভে গুলো শুধু ইংল্যান্ডেই করা হয়েছে। হয়তোবা সারাবিশ্বে সার্ভে করা হলে ফলাফল টা একটু ভিন্ন আসতো।কারণ সারা বিশ্বের আবহাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে যেটা মানুষের দেহের উপর ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। এই Astrazeneca এর পদ্ধতি অবলম্বন করে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে covisheild নামক ভ্যাকসিনতৈরি করা হচ্ছে যা বাংলাদেশে বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে করোনাভাইরাস এর ভ্যাকসিন কোন ভাবেই বিফলে যাবে না। কারণ ভ্যাকসিন নিলে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। যদি আক্রান্ত হয়ে যায় কেউ তাহলে সাধারণ সর্দি-কাশির উপর দিয়েই চলে যাবে ইনশাআল্লাহ।
ইবোলা ভাইরাসের প্রতিষেধক গত এক বছর ধরে আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোভিড-১৯ এর প্রতিষেধক খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছিল। তবে গবেষকরা ধারণা করছেন যে এই ভ্যাকসিন টা অন্ততপক্ষে একবছর কার্যকর থাকবে। আশা করি এই সময়টুকু করোনাভাইরাস এর ট্রান্সমিশন রোধ করার জন্য যথেষ্ট।সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে Astrazeneca কার্যকরিতা প্রায় 55 শতাংশে নেমে আসে, যদি এর দ্বিতীয় dose 30 দিন পর দেয়া হয়। তাই বিজ্ঞানীরা উপদেশ দিচ্ছেন দ্বিতীয় dose যেন ১১ দিন পর দেয়া হয়..।
লেখক :
(ডা. খন্দকার সাদিয়া মেহজাবিন)
Dr. Khandaker Sadia Mehejabeen
MBBS,
MPH (North South University).
Studying MSc in Medical Bioscience at Bradford University, England.
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]