সাতক্ষীরার কলারোয়ায় সেই তারা পেলো আলো। কথাটি শুনে কেমন যেনো মনে হচ্ছে, তাই না?
হ্যাঁ, বিধবা নি:সন্তান চরম অসহায় বৃদ্ধা তারাভান বিবি’র পাশে দাঁড়িছেন কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জুবায়ের হোসেন চৌধুরী। ইতোমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান খাদ্য সামগ্রি ও ঔষধ পাঠিয়েছেন তারা’র কাছে। আর কলারোয়ায় যতদিন পোষ্টিং থাকবে ততদিন ইউএনও তারা’র সার্বিক দায়িত্বভার বহনের ঘোষনা দিয়েছেন।
ঘটনাটি আসলে কী? সেই গল্পটা শুরু থেকে জানলে হয়তো আরো অনেকেই মহতী হাত বাঁড়িয়ে দিতে পারেন।
কলারোয়া পৌরসভাধীন উত্তর মুরারীকাটী ৮নং ওয়ার্ড। বাঁশঝাড়ের মাঝে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর, ঘরের চারপাশে নেই কোন বেঁড়া। ঘরে ছোট্ট একটা ভাঙ্গা বেঞ্চ, কেউ একজন দিয়েছিল। সেই বেঞ্চের উপর সারাদিন শুয়েই এখন কাটে তার জীবন। মাথার বালিশ নেই বলে শক্ত কাঠের পিঁড়ি মাথার নীচে। মাস দেড়েক হতে চললো একা এক নির্জন কুঁড়েঘরেই তার ঠাঁই। তারাভান, এনআইডি অনুযায়ী জন্ম ১৯৫৩ সালের ২৭ জানুয়ারি। তিনি নি:সন্তান, বিধবা। কাছের আপনজন কেউই নেই।
সাতক্ষীরায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের করোনার বিস্তার ঘটতে শুরু করলে করোনার সকল প্রকার লক্ষণ বৃদ্ধা তারা’র ভিতর দেখা দেয়। গ্রামের মানুষ তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। ঘরে কোন খাবার নেই, রান্না করে দেয়ার কেউ নেই, ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ কেনার কোন সামর্থ্যও নেই। সীমাহীন কাশি, শ্বাসকষ্টে ভুগে শরীর নাড়াতে পারেনা। তারপরও মানুষের একটুখানি সহানুভূতি পাওয়ার জন্য, অন্য মানুষের একটু ভালবাসা পাওয়ার জন্য রাঁতের আঁধারে অন্য প্রতিবেশীদের গোয়াল ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিতে গিয়েও পারেননি। জীবনভর সুখে দুখে একসঙ্গে বাস করা প্রতিবেশীরাও সর্বনাশা করোনার কাছে অসহায় হয়ে বাঁচতে চেয়েছে।
প্রায় ৬৯ বছর বয়সী সন্তানহীন বিধবা তারার সাতকূলে আপন বলতে কেউ নেই। স্বামীও দীর্ঘদিন কর্ম অক্ষম থেকে ও শারীরিক-মানসিক সমস্যায় ভুগে কয়েক বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সামান্য এক চিলতে জমিতে সেই কুঁড়েঘরটুকুই তার সম্বল। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ দূরে খাবার রেখে যায়, কেউ গ্রাম্য ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ কিনে দেয়। তবে করোনাকালে গ্রামবাসী সবাই কম বেশী বিপর্যয়ের মধ্যে আছে, তাদেরও সীমাবন্ধতা আছে চারিদিকে। কিন্তু তারার দরকার নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার, সঠিক চিকিৎসা। মরার উপর খাঁড়ার ঘা চলতি বর্ষা মৌসুম। বর্ষাকালে সাপ-পোকামাকরও যনো তার সাময়িক সঙ্গী হয়ে পড়েছে। সেগুলো থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন কুঁড়ে ঘরের সংস্কার। যেটা তারা’র জন্য কল্পনাতীত।
মাস দুয়েক আগেও প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ফুট-ফরমায়েশ খেটে খাওয়া জুটতো বৃদ্ধা তারা’র। গ্রামের মানুষ একবেলা না খেয়েও থাকতে পারে, কিন্তু অন্য মানুষের সঙ্গে কথা না বলে এক ঘন্টাও থাকতে পারে না। সেই মানুষ দেড় মাস ধরে পথের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে- রাস্তা থেকে কে একটু আসবে তার সঙ্গে কথা বলতে, কে একটু খাবার নিয়ে আসবে, একটু ওষুধ কিনে দিবে -সেই আশায়।
কলারোয়া নিউজে সংবাদ দেখে খাবার ও ঔষধ পাঠান উপজেলা চেয়ারম্যান, নিজেই ছুটে যান ইউএনও। সঙ্গে দিয়ে আসেন শাড়ি, খাবার, ফলমূল। বলে আসেন যেকোন প্রয়োজন আর খরচের তিনিই দায়িত্ব নিলেন।
অন্ধকার ঝোপের মধ্যে থাকা তারা’র পাশে আজ আলো।
স্থানীয়রা জানালেন, ‘অভিমানী তারা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে চান না। সামাজিক কুসংস্কার, যাদের সে আপন মনে করে সেই প্রতিবেশীদের দেখতে পারবে না, এমন অনেক আশংকা থেকে তার এই অভিমান। আগে থেকেই তার নানাবিধ শারীরিক জটিলতা বিদ্যমান। এই মূহুর্তে তার দরকার সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার, মানসিক সাপোর্ট, সঠিক চিকিৎসা। তার ছোট্ট জরাজীর্ণ কুঁড়েঘরটির উন্নয়নও জরুরী। অসহায় ও দুঃখী তারা চাচীর পাশাপাশি বৃষ্টি, বজ্রপাতে সেটার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।’
কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরেই তাৎক্ষনিক সেখানে তিনি লোক পাঠিয়েছিলেন। খাদ্য সমাগ্রি ও প্রয়োজনীয় ঔষধ পাঠানো হয়েছে। পরবর্তীতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ আসলে বৃদ্ধা তারা’র জন্য একটি দেয়া হবে।’
এদিকে, বিষয়টি জানতে পেরে রবিবার (১০ জুলাই) সন্ধ্যার পর তারা’র আঙিনায় ছুটে যান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জুবায়ের হোসেন চৌধুরী। সঙ্গে নিয়ে যান খাদ্য সামগ্রি, ফলমূল ও শাড়ি।
শোনা ও জানার চেয়ে স্বচক্ষে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ইউএনও। মানবিকতা আর মনুষ্যত্বের উদাহরণ দেখালেন। বলে আসলেন যতদিন কলারোয়ায় থাকবেন ততদিন তারা’র সকল দায়িত্ব তার কাঁধে। ইউএনও সেখানে গেলে উপস্থিত পাড়া-প্রতিবেশীরাও তারাভানের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন।
ইউএনও জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘খোঁজখবর নেয়ার জন্য গিয়েছিলাম, দেখি চরম অসহায়ত্ব ও দুর্দশার মধ্যে আছেন বৃদ্ধা মহিলাটি। তার কেউ নাই। আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে এসেছি। তাকে বলেছি খাদ্য, চিকিৎসাসহ যেকোন প্রয়োজনে যখনই দরকার হবে আমাকে জানাতে। যতদিন কলারোয়ায় থাকবো ততদিন তার সার্বিক দায়িত্ব নিচ্ছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের ‘খ’ শ্রেণির অর্থাৎ জমি আছে ঘর নেই- এমন বরাদ্দ আসলে তাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে।’
তারাভানের পুরো দায়িত্ব নেয়ার ঘোষনা দিয়ে ইউএনও জানান, ‘তিনি যতদিন কলারোয়ার দায়িত্বে থাকবেন ততদিন তারাভানের যে কোন সমস্যায় তিনি পাশে থাকবেন। তার মোবাইল ২৪ ঘন্টা খোলা, মানুষ তাদের প্রয়োজনে তার শরনাপন্ন হতে পারেন। তারাভান পূনরায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে না পারলে তিনি নিজে চিকিৎসককে সঙ্গে নিয়ে এসে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।’
উল্লেখ্য, কিছু মানুষ এতোদিন বৃদ্ধা তারা’কে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিল যে, সে অসুস্থতা কিংবা অসহায়ত্বের কথা জানালে তাকে ধরে নিয়ে হাসপাতালে আটকে রাখবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘তার সঙ্গে এমনটি কেউ করবে না।’
উপস্থিত জনতা মানবিক ডাকে সাড়া দিয়ে ইউএনও জুবায়েরের এমন ত্বরিত পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানান। একই সাথে কলারোয়াতে তার স্বল্পতম সময়ে বিভিন্ন গঠনমূলক ও মানবিক কাজ করে জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]