তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে ভয়ংকর সব তথ্য পেয়েছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। নারীদের জোরপূর্বক গুম করা হতো। অনেক নারী তাদের সন্তানসহ নিখোঁজ হন। অনেকে আবার নিখোঁজের সময় গর্ভবতী ছিলেন।
গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের আংশিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
এমন এক নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন গর্ভবতী নারী একমাস আটকে ছিলেন। তার তিন বছর ও ১৮ মাস বয়সী দুই শিশুও একই সঙ্গে আটক ছিল। গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও একজন পুরুষ অফিসার ওই নারীকে মারধর করতেন।
আটকে থাকা ছয় বছর বয়সী ছোট্ট এক শিশুর সাক্ষাৎকারও নেয়া হয়েছে জানিয়ে বলা হয়েছে, শিশুটির বয়স মাত্র ছয় বছর, তাকে মায়ের সঙ্গে সিটিটিসিতে আটক রাখা হয়েছিল।
অন্য একটি ঘটনায়, একজন মা এবং তার মেয়েকে তৎকালীন র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে রাতে আটকে রাখা হয়েছিল। পরের দিন মেয়েটিকে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়। মায়ের কোনো খবর ছিল না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবারের মতে, একজন ইমাম শিশুটিকে খুঁজে পেয়ে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা মেয়েটি এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীকে সন্দেহভাজন র্যাব কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে রাতে যে কক্ষগুলোতে তাকে রাখা হয়েছিল তার একটি কক্ষকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হন। তার মা আর ফিরে আসেনি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গুম হওয়াদের মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। আংশিক কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অনেক নারী নির্যাতনের শিকার ও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে সামনে আসতে দ্বিধাগ্রস্ত। অনেক ক্ষেত্রে নারীদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল কারণ তাদের পুরুষ আত্মীয়দের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল।
র্যাবের হাতে আটক মাকে এখনো খুঁজে পায়নি মেয়ে
বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের সময় র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক নারী ও শিশুদের নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা পাওয়া গেছে। কয়েকজন নারী ও শিশু যারা ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিল তাদের কিছু সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে গুম সংক্রান্ত কমিশন। সেখানে গর্ভবতী নারী গুমের শিকার হওয়ার তথ্য মিলেছে। এছাড়াও একজন মেয়ে মায়ের সঙ্গে আটক হওয়ার পর এখনো সে তার মাকে খুঁজে পায়নি।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গুম সংক্রান্ত কমিশনের বরাত দিয়ে এমন কিছু ঘটনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়।
কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে নারী ও শিশুদের গুম হওয়ার ভয়ংকর সব তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে নারীদের জোরপূর্বক গুম করার নানা তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। অনেক নারী তাদের সন্তানসহ নিখোঁজ হন বলেও প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। অনেকে আবার নিখোঁজের সময় গর্ভবতী ছিলেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার উল্লেখযোগ্যভাবে কম সংখ্যক নারী শনাক্ত করা গেছে। এর একটি কারণ হলো পুরুষদের জোরপূর্বক নিখোঁজ করার ঘটনা বেশি ঘটে। কিন্তু সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অনেক নারী তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করেন। তবুও বেশ কয়েকজন সাহসী নারী ভুক্তভোগী আমাদের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। আটকের পর নির্যাতনের ভয়ংকর কিছু বিষয়ও শেয়ার করছেন।
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন মা এবং তার ছোট্ট মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তৎকালীন র্যাব-২ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে। এরপর রাতভর আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। পরের দিন মেয়েটিকে একটি গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হয়। তার মা এখনো ফিরে আসেনি।
পরিবারের ভাষ্যমতে, একজন ইমাম শিশুটিকে খুঁজে পেয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয়। আমরা এ মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছি। সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক। র্যাব যেখানে তাদের নির্যাতন করেছিল সেখানে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি সেই ঘরগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের জোরপূর্বক নিখোঁজ করার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর দিক হলো নারীদের তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিখোঁজ করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ– আমরা একজন নারী ভিকটিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি গর্ভবতী অবস্থায় এক মাস ধরে আটক ছিলেন এবং তার তিন বছর ও ১৮ মাস বয়সী সন্তানদেরও তার সঙ্গে বন্দি রাখা হয়।
ভুক্তভোগী ওই নারী অভিযোগ করেছেন, গর্ভবতী থাকা সত্ত্বেও একজন পুরুষ কর্মকর্তা তাকে মারধর করেছিল। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা একজন শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, সে তার মায়ের সঙ্গে সিটিটিসিতে আটক থাকার কথা স্বীকার করেছে। যখন তার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর।
মা ও শিশুকে বলপূর্বক নিখোঁজ করার এ চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে। চট্টগ্রামের মহানগর পুলিশ থেকে শুরু করে ঢাকার সিটিটিসি কর্মকর্তারা এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
এ ছাড়া একজন পুরুষ ভুক্তভোগী কমিশনের কাছে বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে তার স্ত্রী ও নবজাতক শিশুকে একটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি জানান, আটক অবস্থায় তার শিশু সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর অনুমতি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এটি তার (ভুক্তভোগী) ওপর মানসিক নির্যাতনের একটি রূপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]