বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীর বয়স প্রায় ৫০০ কোটি বছর। ৭০ হাজার বছর আগে যখন সর্বশেষ বরফযুগ শুরু হয়, তখন বিশ্বের জনসংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার। আর বিশ্বের জনসংখ্যা বর্তমানে ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করে তাদের কর্মক্ষম করে তুলতে দরকার গুনগত উন্নয়ন।
সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার শীর্ষে থাকা চীনকে গত এপ্রিল ২০২৩ এ ছাড়িয়ে গিয়েছে এশিয়ার আরেক দেশ ভারত। এই দুই দেশে পৃথিবীর মোট ৩৫ শতাংশ মানুষ বাস করছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউ.এন.এফ.পি.এ) বার্ষিক প্রতিবেদনের হিসাব মতে, বর্তমানে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ।
২০২৩ এর ১৫ এপ্রিল ইউ.এন.এফ.পি.এ’র প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়- ২০২৩ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাড়িয়েছে ৮০০ কোটি ৪৫ লাখ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে ভারতের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৮৬ লাখ আর চীনের ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ।
উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালে চীনের জনসংখ্যা ছিলো ১৪২ কোটি ৬লাখ, অপরদিকে ভারতের ছিলো ১৪১ কোটি ২ লাখ। ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা হতে পারে প্রায় ১৬৬ কোটি ৮লাখ এবং চীনে হ্রাস পেয়ে জনসংখ্যা হতে পারে ১৩১ কোটি ৭ লাখ।
একই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়- ২০২২ সালের হিসাব মতে ৩য় স্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান জনসংখ্যা ৩৩ কোটি ৭০ লাখ, ২০৫০ সালে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাড়াতে পারে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ। বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যার তালিকায় ৪র্থ স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ২৭ কোটি ৫০ লাখ, ৫ম স্থানে পাকিস্তান ২৩ কোটি ৪০ লাখ, ৬ষ্ঠ স্থানে নাইজেরিয়া ২১ কোটি ৬০ লাখ, ৭ম স্থানে ব্রাজিল ২১ কোটি ৫০ লাখ, ৮ম স্থানে বাংলাদেশ ১৭ কোটি ৩০ লাখ, ৯ম স্থানে রাশিয়া ১৪ কোটি ৫০ লাখ, ১০ম স্থানে মেক্সিকো ১২ কোটি ৭০ লাখ এবং ১১তম স্থানে জাপান ১২ কোটি ৪০ লাখ।
উল্লেখ্য যে, আফ্রিকার দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। নাইজেরিয়া বর্তমানে ২১ কোটি ৬০ লাখ, যা ২০৫০ সালে হতে পারে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ। কঙ্গোতে বর্তমানে ৯ কোটি ৭০ লাখ, যা ২০৫০ সালে হতে পারে ২১ কোটি ৫০ লাখ এবং ইথিওপিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ১২ কোটি ২০ লাখ, যা ২০৫০ সালে হতে পারে ২১ কোটি ৩০ লাখ।
প্রকাশ থাকে যে, ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিলো ১০০ কোটি। ১২৩ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হয় ২০০ কোটি। এর ৩২ বছর পর ১৯৫৯ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাড়ায় ৩০০ কোটিতে। এর মাত্র ১৫ বছর পর ১৯৭৪ সালে দ্রæত গতিতে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়ে হয় ৪০০ কোটি। এই বৃদ্ধির হার আরো বাড়তে থাকে। ১৯৭৪ সালের পর ১২/১৩ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০০ কোটি বেড়ে ১৯৮৭ সালে হয় ৫০০ কোটি, ১৯৯৮ সালে ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ৭০০ কোটি আর ২০২২ সালে ৮০০ কোটিতে দাড়ায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এরূপ ধারা অব্যাহত থাকলে ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৯০৭ কোটি আর ২১০০ সালে হতে পারে ১হাজার ৪০ কোটি।
২০২২ সালে (১৫ জুন) থেকে (২১ জুন) পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে এবারই প্রথম ডিজিটাল জনশুমারী ও গৃহগণনা করা হয়।
১৯৮৭ সালের (১১ জুলাই) বিশ্বে জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উপনিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের তৎকালীন গভর্নিং কাউন্সিল জনসংখ্যা বিষয়ক ধারণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৫/২১৬নং প্রস্তাব পাশের প্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
বিশে^র সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন চার দশক আগে চালু করেছিলো এক সন্তানের নীতি। অর্থাৎ এক দম্পত্তি একটির বেশি সন্তান নিতে পারবেন না। কিন্তু অর্থনৈতিক ভিত শক্ত হওয়ার পর ৫বছর আগে নীতি পরিবর্তন করে এক পরিবারে দুই সন্তান নেয়ার অনুমতি দেয় সেদেশের সরকার। ২০২১ সালে এসে চীন এবার ৩ সন্তান নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। যার অর্থ চীন এখন জনসংখ্যা বাড়াতে চাইছে। প্রায় ১৪৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীন তৈরী পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষে। পোশাক রফতানীতে দ্বিতীয় শীর্ষে অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল দেশ। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বের নব্বইতম এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার।
বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৫ দশকের ব্যবধানে ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭২.৮ বছরে। এর মধ্যে পুরুষের গড় আয়ু ৭১বছর ২মাস ও নারীর ৭৪ বছর ৫ মাস।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনের তথ্য মতে, জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে- দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতির দিকে। বর্তমানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১১৪০ জন। পৃথিবীর গড় জনঘনত্বের ২৪ গুন বেশি জনঘনত্ব বাংলাদেশের। তবে সবার আগে প্রয়োজন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বড় বাঁধা কিশোরী মায়েরা।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫০ লক্ষ। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত এদেশের জনসংখ্যা কয়েক গুন বেশি হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্ম হার ছিলো ৬.৩, যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৩।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মোট জনসংখ্যার ৬৬.৬৯ ভাগ অর্থাৎ ১১ কোটি ১৬ লাখ ৭৮ হাজার নারী-পুরুষ কর্মক্ষম। দেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮লাখ মানুষ। বাকী ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ কর্মক্ষম, তবে শ্রমশক্তির বাইরে।
দারিদ্র জয় করে দীর্ঘ ৫০ বছরে বাংলাদেশ আজ বিশে^র বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী- ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিলো ৬৭৬ টাকা। সেই হিসেবে একজন মানুষের দৈনিক আয় ছিলো মাত্র ১টাকা ৮৫ পয়সা। সেখান থেকে ক্রমাগত ভাবে বেড়ে বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় ২৫০০ মার্কিন ডলার। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ (করোনাকাল বাদে)। রপ্তানী আয় ৪৩ বিলিয়ন ডলার। দারিদ্রের হার ২০.৫ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে ভারতের মাথাপিছু আয় ২১৯১ মার্কিন ডলার। আর পাকিস্তানকে অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশী লোক বেড়েছে। উল্লেখ্য যে, বিশ্বে ৬৫ বা ততোধিক বয়সের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি, জাপানে ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। অপরদিকে, ১৫ বছরের কম বয়সী জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি নাইজারে ৪৮ দশমিক ০৯ শতাংশ।
২০৫০ সালে বিশ্বের নতুন জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশই হবে উন্নয়নশীল দেশে বর্তমানে যা ৩৮ শতাংশ রয়েছে। ২০৫০ সালে বিশ্বে মোট জনসংখ্যার ৮৬ শতাংশের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে বলে আশা করছে জাতিসংঘ।
ক্রমবর্ধমান জন্মহার নিয়ন্ত্রণ দেশের উন্নয়নে বড় চ্যালেঞ্জ হলেও এখন জনসংখ্যা বিষ্ফোরণই দেশের একমাত্র সমস্যা নয়।
উপযুক্ত শিক্ষা ও ভালো কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করলে বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যা হওয়া সত্বেও বিশে^র কাছে চীন-জাপানের মতোই দেশের তালিকায় অন্তুর্ভূক্ত হতে পারে। সবক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবু বড় সমস্যা দেশের বিরাট দরিদ্র জনগোষ্ঠি। বিশ^জুড়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হয়। এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, মান সম্মত শিক্ষা, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সেই অনুযায়ী উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে কোন দেশের জনসংখ্যাকে যদি উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে নিয়োজিত করা যায় তবে সেই জনসংখ্যা মূল ভূখন্ডের আয়তনে কম-বেশি যেটাই হোক তা জনশক্তিতে বা জনসম্পদে পরিণত হবেই। এ সম্পদ যেকোন মূল্যবান খনিজ সম্পদ থেকে অধিকতর কার্যকর।
পরিসংখ্যানে বলছে বাংলাদেশের জনসংখ্যাই যেনো দেশটির জনসম্পদ। দেশের সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন সূচক গুলোতেও বিষ্ময়কর উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশ জনবহুল অথচ উন্নয়নশীল দেশ। বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]