ওদের কানে পৌঁছাতো না স্কুলের ঘণ্টা। যে বয়সে হাতে থাকবে বই, কাঁধে থাকবে স্কুল ব্যাগ; সে বয়সে ওরা নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া ধরাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত ছিল। যে বয়সে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা; সে বয়সে ওরা মাথায় বহন করে মাছের ঝুড়ি। হাড়ভাঙা খাটুনির কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ওরা। সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয়। রাতে একটু ঘুম। এ যেন ওদের নিয়তির লিখন। এমন চিত্র সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় জেলেপল্লির শিশুদের। জেলেপল্লির অধিকাংশ শিশু হয়ে ওঠে মৎস্যজীবী। মাছ ধরা, বিক্রি করা, ট্রলার বা নৌকা থেকে ঝুঁড়ি ভরে মাছ নামানো সবই পারে। এ শিক্ষা নিতে হয়েছে পরিবার ও পেটের প্রয়োজনে। এভাবেই শিশু বয়সে শ্রমের জালে আটকে যায় জেলেপাড়ার অধিকাংশ শিশুর জীবন।
দারিদ্র্যের কষাঘাত ওদের শ্রেণিকক্ষে যেতে বারণ করে। আর করোনা এ দরিদ্রতায় যোগ করে নতুন মাত্রা। অনেকেরই স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হতো না। পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে কাজে নামে শিশুরা। শৈশব থেকেই শুরু হয় বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তাদেরকে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করার পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষার জন্য এগিয়ে আসে বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ।
উত্তরণের এডুকো-Educo (Prevention and Elimination of Hazardous From of child labor in Costral Areas of Bangladesh) প্রকল্পের বাস্তবায়নে এবং এডুকো বাংলাদেশ-এর অর্থায়নে বিপদজনক শ্রম চিংড়ী, কাঁকড়া ও মাছ ধরার কাজে জড়িত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করছে সংস্থাটি। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাস করা বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষা দেয়া।
উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই চার টি ইউনিয়নের চারটি লার্নিং সেন্টারে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত লার্নিং সেন্টারে এসে লেখাপড়া করছে এবং এরমধ্য থেকে ২৫ জন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং এবং ২৫ জন ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এছাড়া এই সকল শ্রমজীবী শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও সুযোগ বৃদ্ধির জন্য শিশুদেরকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে উত্তরণের শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, লেখাপড়ায় ব্যস্ত রয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ জন শিশু। আকলিমা খাতুন নামের একজন শিক্ষিকা তাদেরকে পাঠদান করাচ্ছেন। গ্রামের ভাড়া করা ছন-বাঁশ-টিনের স্কুল ঘরগুলোর কাঁচা মেঝেতেই শিশুরা সুশৃঙ্খলভাবে ক্লাস করছে। শিশুকেন্দ্র গুলোর শিক্ষার মান এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুন্দর আচরণে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
এ শিখন কেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নয়ন মন্ডল, ফয়সাল শেখ, মল্লিকা মন্ডল ফুলঝুরি, সীমা বারুই, সোনামনি সরদারসহ কয়েকজন জানায়, শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে পড়তে তাদের ভালো লাগে। কারণ আগে তারা স্কুলে যেতে পারতো না। বর্তমানে কাজের পাশাপাশি তারা এখানে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে। উপকূলীয় এলাকার এই শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে মুক্ত করে শিখন কেন্দ্রে পড়াতে পেরে স্থানীয়দের মাঝেও উৎসাহ দেখা যায়।
মথুরাপুর শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের সভাপতি মিসেস নুরজাহান খাতুন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ঝরেপড়া শিক্ষাবিমুখ শিশুদের কাছে এখন আদর্শ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে শিশুকেন্দ্রটি। এখানে পড়াশুনার মান খুবই ভালো। আগে এখানকার শিশুরা স্কুলে যেতে পারতো না। এখন নিয়মিত স্কুল করার পাশাপাশি তারা অবসর সময়ে মা-বাবার সাথে মাছ ও কাঁকড়া ধরে আয় করে থাকে। তবে নিরাপদ পানি সমস্যা অত্র এলাকায় প্রধান সমস্যা। এছাড়া স্কুল ড্রেস, স্কুল ফিডিংচালু থাকলেও শিশুরা স্কুলে যেতে আরও আগ্রহী হয়ে উঠত।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সোহাগ হোসেন জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসীম কুমার মৃধা বলেন, উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]