হিরোশিমায় বোমা পড়েছিল যেদিন সেদিন ভাগ্যক্রমে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছিলেন মিচিকো ইউশিটসুকা। হিরোশিমার সেদিনের সেই ভয়ংকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা মিচিকো সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন সেই ভয়াবহ স্মৃতি। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের সেই সকালে মিচিকো ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলেছিলেন। সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লেখেন, আমার মনে আছে, আমি ভাবছিলাম যদি পরের ট্রেনটা ধরতে পারি, তাহলেও আমি সময়মতো কাজে পৌঁছাতে পারব। কিন্তু আবার ভাবছিলাম, যদি আমি দৌড়ে স্টেশনে যেতে পারি, তাহলে হয়তো আগের ট্রেনটাই ধরতে পারব। ভাগ্যক্রমে দৌড়ে গিয়ে প্রথম ট্রেনটাতেই উঠতে পেরেছিলেন তিনি। ট্রেন ধরতে পারায় সম্পূর্ণ নতুন জীবন ফিরে পান তিনি।
মিচিকো বলেন, আমি দৌড়ে ইয়োকোগাওয়া স্টেশনে পৌঁছালাম এবং লাফ দিয়ে সেই ট্রেনটিতে উঠতে পারলাম। ঐ ট্রেনটাতে চড়েই আমি প্রতিদিন কাজে যাই। হিরোশিমায় যখন বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে, তখন মিচিকো অনেক দূরে তার কারখানায় নিরাপদ আশ্রয়ে। বিশ্বে সেই প্রথম এবং শেষ কোনো যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল পরমাণু বোমা।
তিনি লিখেছিলেন, যদি আমি সেদিন ট্রেনটি ধরতে না পারতাম, আমি হয়তো ইয়োকোগাওয়া স্টেশন এবং হিরোশিমা স্টেশনের মাঝামাঝি কোনো জায়গায় মারা যেতাম। সেই সময়কার দিনগুলোর বর্ণনায় তিনি বলেছেন, যুদ্ধের কারণে জাপানে তখন ব্যাপক খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। মিচিকোও প্রায়শই খেয়ে না খেয়েই থাকেন। আগের রাতে হিরোশিমার আকাশে চক্কর দিচ্ছিল মার্কিন বি-২০৯ বোমারু বিমান। বারবার শত্রু বিমানের সতর্কতা জানিয়ে সাইরেন বেজে উঠছিল। সকাল ৭টার দিকে শেষবার সাইরেন বাজল, এবারেরটা ‘অল ক্লিয়ার সাইরেন।’ তার মানে বিপদ কেটে গেছে, আকাশে আর কোনো শত্রু বিমান নেই। কিন্তু হিরোশিমার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে জানতেন না মিচিকো। ‘ম্যানহাটান প্রজেক্টের?’ লোকজন ছাড়া কেউই আসলে জানতো না। ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট?’ ছিল মার্কিন সরকারের এক অতি গোপন গবেষণা প্রকল্প। এরাই তৈরি করেছিল বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা।
ইনোলা গে বিমানের পাইলট থেকেই বোমা ফেলা হয়েছিল হিরোশিমায়। বোমা নিক্ষেপের কয়েক ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্রের মারিয়ানা আইল্যান্ডসের তিনিয়ান ঘাঁটি থেকে যাত্রা করে আকাশে উড়ছে ইনোলা গে। যে পরমাণু বোমাটি এই বিমানে বহন করা হচ্ছিল, মার্কিনিরা মজা করে তার নাম দিয়েছিল ‘লিটল বয়’। সকাল ঠিক ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমার ওপর ফেলা হলো বোমাটি। আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ সেদিন বোমা বিস্ফোরণের পর তাত্ক্ষণিকভাবে বা পরবর্তী মাসগুলোতে মারা গিয়েছিল।
বিস্ফোরণের পর আকাশে যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল, হিজিয়ামা পর্বতের অপর পাশ থেকে তা দেখেছিলেন মিচিকো। এই পর্বতই তাদের রক্ষা করেছিল। এরপর যে হট্টগোল শুরু হলো—তার মধ্যে মিচিকো দৌড়ে গেলেন নাকায়ামাটোগের দিকে। এটি এক পাহাড়ি পথ। সেই পথে মিচিকো দেখলেন, হাজার হাজার মানুষ ধ্বংস হয়ে যাওয়া হিরোশিমা থেকে পালাচ্ছে। মিচিকোর ভাষায়, সব জায়গায় কেবল আহত মানুষ। আমি বহু মানুষের পুড়ে যাওয়া, গলিত দেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। বিস্ফোরণের ধাক্কায় বাতাসের চাপে তাদের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনেকের দেহের ভেতরের প্রত্যঙ্গ শরীর থেকে বা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। আমি যখন হাঁটছি, কেউ একজন হঠাত্ আমার গোড়ালি ধরে টান দিল এবং মিনতি করতে থাকল, তুমি কি আমাকে একটু পানি দিতে পার? আমি তার হাতটা ছাড়িয়ে দিলাম এবং বললাম, আমি দুঃখিত, আমাকে মাফ করো! আমার খুব ভয় করছিল এবং আমি পালানোর জন্য দ্রুত হাঁটতে থাকলাম। গিওনে গিয়ে মিচিকো যখন দেখলেন, তার মা জীবিত, তখন যেন কিছুটা স্বস্তি পেলেন। কিন্তু তখনো তাদের থামবার সুযোগ নেই। তিনি লিখেছেন, আমি আর আমার মা এরপর ১০ দিন ধরে হিরোশিমার চারদিক হেঁটেছি। আমরা আমার বড় ভাইকে খুঁজছিলাম। ও ছিল একজন সৈনিক। আমরা পরে আবিষ্কার করি ও মারা গিয়েছিল বিস্ফোরণের একেবারে কেন্দ্রে। আমার ভাইয়ের দেহবশেষ আমরা কোনোদিনই খুঁজে পাইনি।
বোমা হামলার তিন দিন পর থেকেই আবার ট্রেন, ট্রাম আর বাস চলতে শুরু করে। দুই মাসের মধ্যে স্কুল খুলল। ক্লাস নেওয়া হচ্ছিল প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্কুলভবন কিংবা খোলা আকাশের নিচে। হিরোশিমা আবার ছাই থেকে উঠে দাঁড়াল।
সূত্র:বিবিসি
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]