৭ই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর সরকার গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। একইসঙ্গে দলটির তরফ থেকে বলা হয়েছে, একদিকে বিএসএফের গুলি ও অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ছোড়া গোলায় বাংলাদেশ এখন ক্রসফায়ারের মুখে রয়েছে। বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
৭ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন ও দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
এতে দলের পক্ষে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরার পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
তিনি বলেন, একদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরম্ভ করে সীমান্তে প্রতিনিয়ত গুলিবর্ষণের মাধ্যমে আমাদের বিজিবি সদস্য ও দেশের জনগণকে হত্যা করছে, আবার পূর্ব দিক থেকে মিয়ানমারের পুলিশ ও সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গোলাগুলিতে এ পর্যন্ত দু’জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়েছেন। ঝাঁকে ঝাঁকে রাখাইন থেকে সেনা পলায়ন করে এখানে আশ্রয় গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ এখন ক্রসফায়ারের মুখে। এটি নিয়ে শুধু আমাদের নয়, আপনাদেরও (সাংবাদিক) ভাবতে হবে যে কী ঘটতে যাচ্ছে- এর অন্তরালে কী আছে।
মিয়ানমার সীমান্তের পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি’র মূল্যায়ন জানতে চাইলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে সরকার নানা সময় যৌথভাবে অপচেষ্টা চালিয়েছে। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া নতুন কোনো ষড়যন্ত্র কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
ব্যর্থতা দূরে রাখতে সরকার নিজেরাই বাইরের শক্তিকে নিয়ে কোনো পরিস্থিতি তৈরি করছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
তিনি বলেন, শুধু ক্ষমতায় থাকতে বারবার দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি এমন অসহনীয় থাকলে দেশের অর্থনৈতিক, কূটনীতিসহ সকল খাতে বিপর্যয় হবে। এর দায় সরকারকে নিতে হবে।
বিএনপি আন্দোলন থেকে সরে এসেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে গয়েশ্বর বলেন, আন্দোলনের গতিবিধি এক থাকে না। বিভিন্ন সময় আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হয়। বিএনপি’র আন্দোলন চলমান আছে, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি শিগগিরই আরও স্পষ্ট হবে বলেও জানান গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
সরকার গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন: এর আগে লিখিত বক্তব্যে বর্তমান সরকারকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার নিজ অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে, অবৈধ অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সুবিধা দিয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন আদায় করেছে। বিশেষ করে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, অসম দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, নামমাত্র মূল্যে ট্রানজিট সুবিধা, পানি সমস্যার সমাধানহীনতা, গোপন আমদানি চুক্তিসহ জাতীয় স্বার্থবিরোধী অজস্র প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। গয়েশ্বর রায় বলেন, যার প্রমাণস্বরূপ ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের সময় ভারতই আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাস, রাষ্ট্রযন্ত্রের একাংশের ধ্বংসযজ্ঞ এবং বিতর্কিত দেশগুলোর হস্তক্ষেপ এই সমন্বিত অপশক্তিকে উপেক্ষা করে জনগণের সমর্থনকে উৎস হিসেবে ধারণ করে বিএনপি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় অবিচল রয়েছে।
‘নির্বাচন ছিল জাতির সঙ্গে সহিংস প্রতারণা’: গয়েশ্বর রায় বলেন, ৭ই জানুয়ারি প্রহসনমূলক নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরং নির্বাচনের নামে এটি ছিল জাতির সঙ্গে একটি সহিংস প্রতারণা- যার উদ্দেশ্য অবৈধ, অনৈতিক ও অসাংবিধানিকভাবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা। ডামি প্রার্থী, ডামি দল, ডামি ভোটার ও ডামি পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচন মঞ্চস্থ হয়েছে।
‘৫০ লাখ নেতাকর্মী নাগরিক জীবন থেকে বঞ্চিত’: পৃথিবীতে বিএনপি’র মতো নির্যাতিত আর কোনো রাজনৈতিক দল আছে কিনা- সে প্রশ্ন তুলে গয়েশ্বর রায় বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে ৫০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা দায়ের করা হয়েছে? কোন অপরাধে ২ হাজার ৭০০-এর বেশি নেতাকর্মীকে শেখ হাসিনা ও তার অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হত্যা, প্রায় ৭০০ জন নিরপরাধ মানুষকে গুম করেছে? বানরের পিঠা ভাগের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৫ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে কেন ফ্যাসিস্ট সরকার পরিকল্পিতভাবে গ্রেপ্তার করেছে? এই সময়ে বিএনপি’র রাজনীতি করার অপরাধে কেন ১১ জন কর্মীকে কারাগারে হত্যা করেছে? কিসের ভিত্তিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাক্?স্বাধীনতা হরণ করে একের পর এক সাজানো মামলায় পাতানো রায় দেয়া হচ্ছে? বিএনপি’র ৫০ লাখ নেতাকর্মী তাদের নাগরিক জীবন থেকে বঞ্চিত-এমন দাবি করে বিএনপি বলেছে, ‘আমাদের প্রত্যেকে প্রতিদিন, পুলিশি নিপীড়ন ও বিচার বিভাগের অবিচারের শিকার হচ্ছি।’
গায়েবি ও বানোয়াট মামলায়, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই, তালিকা করে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বিএনপি ও সকল অঙ্গসংগঠনের সর্বস্তরের সদস্যদের বিরুদ্ধে। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত-নির্বিচার এই গণতালিকা ও সাজানো রায় থেকে বাদ যাচ্ছেন না। এমনকি মৃত বা গুম ব্যক্তিরাও-যারা একসময় বিএনপি’র যেকোনো পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন-তারাও বাদ যাচ্ছেন না এর থেকে।
গয়েশ্বর রায় বলেন, শেখ হাসিনার খুঁটি ও তার ফ্যাসিবাদের ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি সুবিধাভোগী অংশ। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, প্রশাসন ও আদালতের কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারে পরিণত হয়েছেন। তারাই আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনে পরিণত করেছেন বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, দুনীতি দমন কমিশনসহ সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
‘যেটি বানানো হচ্ছে, সেটিই পৃথিবীর সবচেয়ে খরচবহুল’:
বাকশালের মতো করেই বাংলাদেশে আবারো ১৯৭৫ সালের মতোই শেখ হাসিনা একদলীয় শাসন কায়েম করতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার একমাত্র সাফল্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত রেখে পৃষ্ঠপোষকতা করছে লাগামহীন নৈরাজ্য ও লুটপাটে। চালাচ্ছে মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতি। প্রতিটি খাতের প্রতিটি খরচেই হাসিনা সরকারের অস্বাভাবিক লুটপাটে বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া হওয়ার পথে।
বিএনপি’র দাবি, ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে খরচবহুল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র! পায়রাতে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার যে সমুদ্রবন্দর হচ্ছে, এটি এ যাবৎকালে সর্বোচ্চ খরচবহুল সমুদ্রবন্দর। রূপপুরের ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকায় যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এটিও পৃথিবীর সর্বোচ্চ খরচের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র! একইভাবে সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকার যে মেট্রোরেল প্রজেক্ট, প্রতি কিলোমিটার হিসেবে সেটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল। শুধু তাই না, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বিমানবন্দর-গাজীপুর র্যাপিড বাস ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পটি পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল। শেখ হাসিনা সরকারের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের এমন দুর্বিষহ অবস্থা যে রাস্তা, ব্রিজ, রেল, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র- যখন যেটি বানানো হচ্ছে সেটিই দুনিয়ার সর্বোচ্চ খরচের প্রকল্প হয়ে যায়!
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. সিরাজুদ্দিন আহমেদ, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, সুকোমল বড়ুয়া, তাহসিনা রুশদির লুনা, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, হারুন অর রশিদ প্রমুখ।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]