আগামী শনিবার (১০ ডিসেম্বর) ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ করবে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। সমাবেশ করতে বিএনপির পক্ষ থেকে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল নয়াপল্টনে। যদিও সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৬ শর্তে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। সঙ্গে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে ৪ ঘণ্টা। এতে ঘোর আপত্তি বিএনপির। তারা নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে ‘অনড়’। এ নিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি বাকযুদ্ধ, হুমকি-ধমকি।
পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে রাজধানীতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে-অলিগলিতে পাহারা বসানো হবে। এজন্য নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলছে বিএনপি। বড় দুই দলের রাজপথ দখলের এই অটল অবস্থানের কারণে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে নানা মহলে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে জনমনে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন— ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘাত না সম্প্রীতির দিকে যাচ্ছে দেশ। যদিও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দাবি— পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কথার লড়াইয়ের মাঝেও ১০ ডিসেম্বর ঘিরে কিছুটা নমনীয়। বিএনপি তার কঠোর অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে সরকারও তার কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
আওয়ামী লীগ সূত্রমতে, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেয়ার স্বার্থে সরকারি দল তাদের ছাত্রলীগের সম্মেলন তিন দিন এগিয়ে ৬ ডিসেম্বর করবে। তবে বিএনপির ঢাকার সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীতে প্রবেশ পথগুলোতে সতর্ক অবস্থানে থাকবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পাড়া-মহল্লায় তারা শক্ত অবস্থান নেবে। ঢাকার প্রবেশ দ্বারেও থাকবে মহড়া। তবে শেষ মুহূর্তে নয়া পল্টনেই সমাবেশ করার অনুমতিও পেতে পারে বিএনপি।
এছাড়াও কাগুজে শর্ত কঠিন হলেও বাস্তবে ততটা কড়াকড়ি আরোপ করা হবে না। বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে চাইলে তারা নির্বিঘ্নে করতে পারবে। তবে সমাবেশকে কেন্দ্র করে কোনো বিশৃঙ্খলা করতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কঠোরভাবে মোকাবিলা করবে।
তবে বিএনপির সূত্র বলছে, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ হবে শুধুই বিভাগীয়। আগের ৯ বিভাগীয় কর্মসূচির মতো এই সমাবেশও অনেকটা একই। তবে ঢাকার এই সমাবেশ থেকে কর্মসূচি দেবে বিএনপি। পাশাপাশি সরকার ও দেশের মানুষের উদ্দেশে নির্দিষ্ট বার্তা তুলে ধরবে বিএনপি।
দুই দলের এই মুখোমুখি অবস্থায় সংঘাতের শঙ্কা করছেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা সংঘাত চান না। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে চান। কিন্তু কেউ আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। যদিও এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তারা বলছেন, সংঘাতের বিষয়টি আগাম বলা যায় না। সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। বড় দুই দলে রাজনৈতিক দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবে স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে প্রত্যেক দলকেই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ, মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ এতে সংঘাতের শঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এরই মধ্যে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের বলেছেন, তাদের (বিএনপি) সমাবেশে যেন কোনো বাধার সৃষ্টি না করা হয়। আমার মনে হয় না যে, এরপর আর সংঘাতের কারণ আছে।
সব দলকে সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে সড়ক পরিহারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রাস্তায় সমাবেশ করলে জনভোগান্তি বাড়ে। রাজপথে বড় ধরনের সমাবেশ করা কোনো দলেরই উচিত নয়। ছোটখাটো সমাবেশ রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হতে পারে। কিন্তু কোনো দল যদি রাস্তায় বড় সমাবেশ করে তাহলে সার্বিকভাবে পুরো ঢাকা শহর অচল হয়ে যায়। আমরা আশা করি, সব রাজনৈতিক দল দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এখানে সংঘাত-সংঘর্ষ-সন্ত্রাসও চাই না, রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু সমাবেশের কারণে বসে থাকতে চাই না।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আরও বলেন, আমরা অতীতেও দেখেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন রাজপথে সমাবেশ করে পুরো শহর অচল হয়ে যায়। এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরি। ১০ ডিসেম্বর যেহেতু সরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুমতি দিয়েছে, এখন বিএনপি যদি রাজপথ ছেড়ে উদ্যানে যায় এবং সব রাজনৈতিক দলই যদি এ সিদ্ধান্ত নেয় আর কোনো সভা-সমাবেশ রাজপথে করবে না। যত সমাবেশ হবে মুক্ত ময়দান বা খোলা মাঠে বা বিভিন্ন মিলনায়তনে। এটা হবে উত্তম পদ্ধতি। তবে কোনো দলই তা মানতে চায় না।
সংঘাতে জড়ালে সমুচিত জবাব দেবে আ’লীগ: সম্প্রতি ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিকে ঘিরে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে বিএনপিকে সহজে ছাড় দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে ‘সতর্ক পাহারার’ নামে আওয়ামী লীগ ঢাকাকে মোটামুটি অবরুদ্ধ করে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছে। দুই বা তিন দিন আগেই ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে বলেও এমন গুঞ্জন রয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলে তাতে বাধা দেয়া হবে না। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরির্বতে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চাইছে বিএনপি ভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করতে। বিএনপিকে শান্তি নষ্ট করার সুযোগ দেয়া হবে না।
ওই সমাবেশ ঘিরে সংঘাতের আশঙ্কাও করছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, সরকার ইতিবাচক বলেই নয়াপল্টনের মতো ছোট জায়গার পরিবর্তে বড় পরিসরের ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার ব্যাপারে অনড় থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে, শান্তি-স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়োজনে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। এটি কি মগের মুল্লুক, যে জোর করে সমাবেশ করবে?
ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি গায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ গায়ে পড়ে ঝগড়া করবে না। বিএনপি যদি আন্দোলনের নামে সহিংসতার উপাদান যুক্ত করে, তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। আওয়ামী লীগের প্রত্যেক নেতাকর্মী রাজধানীজুড়ে সতর্ক পাহারায় থাকবে, যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, জনগণের সম্পদ নষ্ট করতে না পারে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং বর্তমান দুর্যোগময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব প্রকার সংঘাত এড়িয়ে চলবে। বিএনপি-জামায়াত বা যে কেউ কোনো ধরনের সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করলে রাষ্ট্র আইনানুগ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
‘নয়াপল্টন’ শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায় বিএনপি: ঢাকার বাইরের বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোতে বাধার মুখেও বড় জমায়েত করতে সফল হয়েছে বিএনপি। ফলে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঙ্গা ভাব তৈরি হয়েছে। ঢাকায় পরিবহন ধর্মঘট আসলে জনস্রোত ঠেকানো যাবে না। তবে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ভালো নয়। তবে আগের ৯টি সমাবেশ বিএনপি শান্তিপূর্ণ করেছে। ঢাকায়ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ হবে, এটা দলগত সিদ্ধান্ত। এ সরকার শুধু ঢাকার ১০ তারিখের প্রোগ্রাম নয়, সারাদেশের সব বিভাগে এমন বাধার সৃষ্টি করেছে। তারপরও বিএনপি সেই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে প্রত্যেকটা জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করেছে। এটা বিএনপি ও জনগণের ক্রেডিট। জনগণই এই ক্রেডিটটা জাতির সামনে তুলে ধরেছে। সাধারণ মানুষ আমাদের যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখিয়েছে, সহযোগিতা করেছে, আমাদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে তারা একমত পোষণ করেছে। সুতরাং আগামী ১০ তারিখও আমরা সবাইকে সংযুক্ত করছি। সব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেই ঢাকায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করবে বিএনপি।
দলটি বলছে, ঢাকা সমাবেশ ঘিরে এরইমধ্যে ধরপাকড় শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সারাদেশে নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। পুরানো মামলা নতুন করে সামনে আনা হচ্ছে। গত তিন দিনে সারাদেশ থেকে ৭৭৬ন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও জানায় দলটি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, সরকার বলে তারা সংবিধান মতো চলে। সংবিধান আমাদের অধিকার দিয়েছে। আমরা কর্মসূচি করব। পুলিশের অনুমতির বিষয়টি সংবিধানে নেই। ডিএমপির নিজস্ব আইনে মাইক ব্যবহার করার অনুমতির বিধান যুক্ত করছে। আমরা সে অনুমতিও চেয়েছি। সংঘাত এড়াতে হলে আমাদের সেভাবেই অনুমতি তাদের দেয়া উচিত, যাতে সংঘাত না হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা তো বেশিরভাগ সময়ই পার্টি অফিসের সামনে অনুমতি নিয়েই কর্মসূচি করে আসছি। এখনও সেখানেই বিএনপি অনুমতি চেয়েছে। কেন যে তারা এই অনুমতিবিমুখ হচ্ছে, এটা আমার বোধগম্য নয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগরের উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বলেন, অবৈধ আওয়ামী সরকারের ঘৃণ্য চক্রান্ত ও সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ঢাকার গণসমাবেশ সফল হবে। ঢাকার গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিস্ট সরকার এখন তীব্র মাত্রায় নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। কিন্তু কোন অপচেষ্টাই ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশকে ঠেকাতে পারবে না সরকার। জনগণের উত্তাল স্রোতে শাসকগোষ্ঠীর সকল চক্রান্ত ও নীল-নকশা ভেস্তে যাবে।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]