
জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান প্রধান দাবি ও অবস্থান। তবে তিনি এমনভাবে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন যে, কোনো পক্ষই পুরোপুরি অসন্তুষ্ট নয়-আবার পুরোপুরি সন্তুষ্টও নয়।
ভাষণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের ঘোষণা। এই সনদকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আলোচনার মূল বিষয়বস্তু গড়ে উঠেছিল। বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, গণফোরাম ও নাগরিক ঐক্য শুরু থেকেই দাবি করে আসছিল যে, সনদে বর্ণিত গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হোক। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে সেই দাবিই কার্যত মেনে নিয়েছেন। ফলে এই অংশে বিরোধী জোটের অবস্থান ভাষণে স্পষ্ট প্রতিফলন পেয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ইসলামি দল নির্বাচনপূর্ব গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই দাবিটি ভাষণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা গণভোটের আগে সংলাপ ও গণশুনানির মাধ্যমে জনগণের মতামত নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেটি এসব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে।
আওয়ামী লীগের দাবির জায়গা ছিল অন্যখানে। দলটি চাইছিল, সংবিধান সংস্কারের আলোচনায় যুদ্ধাপরাধ ও রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনবিষয়ক ধারা যেন অক্ষুণ্ন থাকে। ভাষণে ড. ইউনূস সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ এসব মৌলিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখবে। ফলে আওয়ামী লীগের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
বাম দলগুলো শুরু থেকেই সংসদীয় ব্যবস্থায় ‘দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কাঠামো’ গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছিল, যাতে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধিত্ব আরও বিস্তৃত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে বলেছেন, গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে ভোটের অনুপাতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। এ অংশে বামদের দীর্ঘদিনের প্রস্তাব সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে।
ভাষণে নাগরিক সমাজ ও তরুণ প্রজন্মের বিষয়েও আলাদা বার্তা ছিল। শিক্ষা, স্বচ্ছতা ও স্থানীয় প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণের প্রসঙ্গ এনে তিনি তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে আশার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সুশীল সমাজের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ‘জনসম্পৃক্ত সংস্কার কমিশন’-প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবিত সংবিধান সংস্কার পরিষদে সে ধারণার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে।
সবমিলিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ ছিল এক ধরনের ভারসাম্যের প্রয়াস। কেউ পুরোপুরি জয়ী নয়, আবার কেউ পুরোপুরি বাদও পড়েনি। বিএনপি পেয়েছে গণভোটের তারিখ, আওয়ামী লীগ পেয়েছে সংবিধানের মূল ধারাগুলোর নিশ্চয়তা, বামরা পেয়েছে উচ্চকক্ষের প্রতিশ্রুতি, ইসলামি দলগুলো পেয়েছে আলোচনায় অংশ নেওয়ার দরজা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ভাষণ মূলত এক ধরনের ‘সমঝোতার রূপরেখা’। এতে প্রধান উপদেষ্টা দেখাতে চেয়েছেন-রাষ্ট্র পরিচালনায় কারও একক মালিকানা নেই, সবাইকেই জায়গা দিতে হবে।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]