সাতক্ষীরার তালায় চাঞ্চল্যকর লুৎফর নিকারী হত্যা মামলা আদালতের নির্দেশে পুনঃতদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল তালার জেয়ালানলতা গ্রামের সরকারী গেটের খাল পরিদর্শন করেছে সিআইডির একটি দল। এসময় মামলার প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী রফিকুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
হত্যা মামলার প্রধান আসামি সরকারি দলের বহিষ্কৃত নেতা হওয়ায় প্রভাব বিস্তার করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার আশংকা করছেন নিহতের পরিবার।
মামলার বাদী নিহতের ছেলে সেলিম নিকারীসহ প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী তারিফ নিকারি, রুহুল আমিন নিকারি, মুছা নিকারীসহ বাদি সেলিম নিকারী প্রতিবেদককে জানান, ২০২০ সালের ১৭ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেলিম নিকারী (৩৫) ও তারিফ নিকারী (৫৫) চাড়িভাঙ্গা সরকারী গেটের খালে মাছ ধরতে যায়। মাছ ধরার জন্য খালটিতে জাল ফেলে মাছ ধরতে থাকে তারা। খালের পাশ্ববর্তী ১২০ বিঘার একটি মৎস্য ঘের হত্যা মামলার প্রধান আসামী সরদার মশিয়ার রহমানের। সেই ঘেরের পাহারাদার মামলার ৩ নং আসামী তুহিন শেখ (৩২) সেলিম নিকারীকে জোরপূর্বক আটক করে রাখে। ২ নং আসামী অপর পাহারাদার বারুইহাটি গ্রামের রনি বিশ্বাস (২৮) মোবাইল ফোনে প্রধান আসামী সরদার মশিয়ার রহমানকে সংবাদ দেয়। সেই সংবাদে রাত্র অনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় সরদার মশিয়ার।
অপরদিকে সেলিম নিকারীকে আটক করে চড়, কিল ঘুষি মারপিট করতে থাকে। সেই খবরটি সেলিম নিকারীর বাবা লুৎফর নিকারীকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানায় সেলিমের সঙ্গে থাকা তারিফ নিকারী।
ঘটনার বিবরণে তারা আরও জানায়, সেলিমকে মারপিট করছে এমন খবর শুনে তার বাবা লুৎফর নিকারী প্রতিবেশী রুহুল আমিন নিকারী, মুছা নিকারী, রফিকুল নিকারীসহ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে প্রধান আসামী মশিয়ার সরদার সেলিম নিকারীকে জীবনে শেষ করে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে। তখন ৩ নং আসামী তুহিন সেখ সেলিম নিকারীর কোমরে থাকা গামছা টেনে খুলে ফেলে হত্যার উদ্দ্যেশে গলায় গামছা পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করে। এসময় সেলিম নিকারীর বাবা লুৎফর নিকারী বাঁচানোর চেষ্টা করলে সরদার মশিয়ার রহমান ডান পা দিয়ে হত্যার উদ্দ্যেশে বুকে লাথি মারে। সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে লুৎফর নিকারী (৬৫) পাশের পানির মধ্যে পড়ে যায়। স্বাক্ষীরা লুৎফর নিকারী ও সেলিম নিকারীকে উদ্ধার করে তালা হাসপাতালে নিয়ে আসে। জরুরী বিভাগে চিকিৎসা টেবিলে ডাক্তার লুৎফর নিকারীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে মৃত ঘোষনা করেন।
ঘটনার স্বাক্ষীরা আরও জানান, সে সময়ে সেলিম নিকারীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজারো গ্রামবাসী জড়ো হয় হাসপাতাল চত্বরে। হত্যার বিচার দাবি করেন তারা।
এদিকে, ঘটনার রাতেই লুৎফর নিকারী হত্যার প্রধান আসামী সন্ত্রাসী সরদার মশিয়ার রহমানকে গ্রেফতার করে তালা থানা পুলিশ। ১৮ আগষ্ট সকালে হাজারো গ্রামবাসী হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করে তালা থানা ঘেরাও করে অবস্থান নেয়। অপরদিকে, পরিস্থিতি উত্তপ্ত অবস্থায় তৎকালীন তালা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার তালা হাসপাতালে আসেন ও সেলিম নিকারীর জবানবন্দী গ্রহণ করেন। ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পান ও তৎকালীন থানা অফিসার ইনচার্জকে মামলা নথিভুক্ত করার নির্দেশনা দেন। এরপর সেলিম নিকারী বাদী হয়ে তালা থানায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৭। তারিখ ১৮.৮.২০ ইং। ধারা ৩০২,৩০৭,৩২৩, ১১৪।
সুরতহাল রিপোর্টে তালা থানার তৎকালীন এস,আই প্রিতীশ কুমার সুরতহাল রিপোর্টের প্রথম পাতার শেষের পাঁচ ছয় লাইনে দাঁত দুপাটি আটকানো উল্লেখ করেন।শেষের পাতায় লেখা রয়েছে, সেলিম নিকারী কোলাস বিলে সরকারী খালে জাল পেতে ভেঁড়িতে উঠলে ঘেরের পাহারাদাররা সেলিম নিকারীকে আটক করে। এখন সেলিমের বাবা ভিকটিম লুৎফর রহমান ঘটনাস্থলে গেলে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে তার বুকে লাথি মেরে পানিতে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর পানি থেকে উঠিয়ে লোকজন কিছুদুর ধরাধরি করে নিয়ে এসে ভ্যানযোগে তালা হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত বলে জানায়।
এই হত্যাকান্ডের পর মামলার প্রধান আসামী সরদার মশিয়ার রহমানকে উপজেলা আ.লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে বহিষ্কার করে জেলা আ.লীগ। তবে সরদার মশিয়ার রহমান উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে থাকায় মামলাটি ভিন্নখানে প্রবাহিত করার চেষ্টায় থাকে প্রভাবশালী চক্র। অবশেষে হত্যা মামলার দায় থেকে মশিয়ারকে বাদ দিতে সক্ষম হয় সেই চক্রটি।
মামলার তদন্তকারী অফিসার ৩০৭ ও ৩২৩ ধারায় তুহিন শেখ ও রনি বিশ্বাসের নামে আদালতে অভিযোগপত্র দালিল করেন। বাদ দেওয়া হয় প্রধান আসামী সরদার মশিয়ারকে। মামলার স্বাক্ষী ও বাদীপক্ষ আদালতে তঞ্চকী অভিযোগ পত্রের বিরুদ্ধে নারাজী পিটিশন দাখিল করেন। আদালত উভয়পক্ষ শুনানী শেষে মামলাটি সিআইডিকে পুনঃতদন্তের নির্দেশনা প্রদান করেন।
আদালতের নির্দেশনায় সিআইডি তদন্ত শুরু করার পর মামলার বাদী ও স্বাক্ষীদের আবারও ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছে আসামীরা। এ ঘটনায় তারা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়।
মামলার বাদী সেলিম নিকারী আরও জানান, হত্যা মামলায় বাদী পক্ষের এজাহার নামীয় স্বাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ না করে আসামীকে বাঁচাতে এজাহারে নাম নেই এমন ব্যক্তিদের স্বাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। যারা আসামীদের সহযোগী। এটি থেকেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় হত্যার ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।
হত্যাকান্ডের পর জেলা আ.লীগের তৎকালীন সভাপতি মুনসুর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়, সরদার মশিয়ার রহমান আওয়ামী লীগের পদ পদবী ব্যবহার করে তালা উপজেলার গোটা ১২ ইউনিয়নে ব্যক্তিগত সন্ত্রাসী বাহিনী গঠণ করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে দলের ভাবমুর্তি নষ্ট করছেন। সে কারণে তাকে দল থেকে সাময়িক ভাবে বহিষ্কার করা হলো।
হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে পৃথক পৃথকভাবে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট স্বারকলিপি প্রদান করে।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]