তিন দশক আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক ভারতীয় নারী। প্রতিবেশী দুই ভাই মিলে তাকে যৌন হেনস্তা করেছিল। এতোদিন পর তিনি সেই জঘন্য ঘটনার বিচার পাওয়ার আশা করছেন। আর সেই বিচার পাওয়ার লড়াইয়ে তাকে সহায়তা করেছে সেই সন্তান, যার জন্ম হয়েছে ওই ধর্ষণের ফলে।
উত্তর প্রদেশের ওই নারীর বয়স যখন ১২, তখন তাকে দুই ব্যক্তি ধর্ষণ করে।
ওই ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানকে দত্তক দেওয়া হয়েছিল। সেই সন্তান ১৩ বছর পর আবার তার মায়ের কাছে ফিরে আসেন এবং সেই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে মাকে উৎসাহিত করেন।
দশ দিন আগে একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অন্য জনকেও নেওয়া হয়েছে পুলিশ হেফাজতে।
ধর্ষণের শিকার ওই নারী বলেন, ‘ঘটনাটা বেশ পুরনো কিন্তু সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি।’ ‘সেই ঘটনায় আমার জীবন এখনও স্থির হয়ে আছে এবং বারবার আমার সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে।’
ভারতে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু যৌন হেনস্তার শিকার হন। ২০২০ সালে ভারতের যৌন অপরাধ থেকে শিশু সুরক্ষা আইনে ৪৭ হাজার মামলা নিবন্ধন করা হয়েছে।
‘তারা আমার হৃদয়ে আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেয়’
উত্তর প্রদেশের ধর্ষণের শিকার ওই নারী জানান, ১৯৯৪ সালে শাহজাহানপুর শহরে এই ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত মোহাম্মদ রাজি ও তার ভাই নকি হাসান তারই প্রতিবেশী, তারা দেয়াল টপকে তার বাড়িতে আসেন এবং তাকে নির্যাতন করেন; তখন তিনি একা ছিলেন।
পরে তার বোন বুঝতে পারেন তিনি অন্তঃসত্তা এবং তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। তবে স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় চিকিৎসকরা তার গর্ভপাত করতে রাজি হননি। ফলে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরই তাৎক্ষণিকভাবে তাকে দত্তক দেওয়া হয়।
ওই নারী বলেন, ‘আমি ওই সন্তানের জন্য অনেক ভুগেছি কিন্তু আমি একটিবারের জন্য তার মুখও দেখার সুযোগ পাইনি। যখন আমি আমার মাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি বললেন, তুমি জীবনে আরেকটা সুযোগ পেলে।’
ওই সময় অভিযুক্ত ধর্ষকদের ভয়ে তার পরিবার থানায় মামলা করেননি। ধর্ষণের শিকার নারী বলেন, ‘ধর্ষণের কথা কাউকে বললে তারা আমার পরিবারের সবাইকে হত্যা ও ঘরে আগুন দেওয়ার হুমকি দেয়।’ ‘আমার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে পুলিশ হব, তবে ওই দুইটা (ধর্ষক) লোকের জন্য আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। আমি স্কুলে যেতে পারিনি, পড়তে পারিনি।’
পরে ওই নারীর পরিবার রামপুর জেলায় চলে যায়। ২০০ সালে তাকে বিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি দ্বিতীয় সন্তানের মা হন। তিনি ভেবেছিলেন অতীত ভুলে এখানে নতুন শুরু করবেন। তবে ছয় বছর পর তার স্বামী ওই ধর্ষণের ঘটনা জানতে পারে এবং সে জন্য তাকেই দায়ী করে, এরপর তাকে ছেড়ে চলে যান। তিনি বোনের সাথে থাকতে শুরু করেন।
সত্যের খোঁজে এক সন্তান
তার দত্তক দেওয়া প্রথম সন্তানও নিজের জন্ম পরিচয় নিয়ে নানা বৈষম্যের শিকার হন। তার প্রতিবেশীরা তাকে বলেছে, সে তার বর্তমান বাবা মা’র সন্তান নন, তাকে তারা দত্তক নিয়েছেন।
১৩ বছর পর বাধ্য হয়ে তাকে দত্তক নেওয়া পিতা-মাতা আসল মায়ের কাছে নিয়ে আসেন। সেখানে এসেও মেলেনি পিতৃ পরিচয়। তার নেই কোন বংশ পরিচয়। ফলে স্কুলে তাকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
তারপর মায়ের কাছে বারবার তার বাবার নাম জানতে চান ওই ছেলে। আর যদি নাম না বলা হয় তবে আত্মহত্যা করবেন বলেও হুমকি দেন। একসময় বাধ্য হয়ে মা আসল ঘটনা সন্তানের কাছে খুলে বলেন।
এরপর ওই সন্তানই ধর্ষকদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যেতে মাকে উৎসাহিত করেন।
বিচারের জন্য লড়াই
সন্তানের অনুপ্রেরণায় ২০২০ সালে আবার শাহজাহানপুরে যান ওই নারী। তবে সেখানে গিয়ে দেখলেন ধর্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা অতোটা সহজ নয়। দীর্ঘ দিন আগের ঘটনা হওয়া পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে রাজি হয়নি। তারা বলেছে, এটা তিন দশক আগের ঘটনা, এই মামলায় জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব।
তার আইনজীবীও তাকে বলেন, ‘তিন দশ আগে আপনি এখানে বাস করতেন এবং এখানেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তা আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন?’
ওই নারী বলেন, ‘আমি তাকে বললাম, আমি প্রমাণ দিতে পারবো; আপনি মামলাটা নেন।’ নানা ধাপ অতিক্রম করে ২০২১ সালের মার্চ মাসে মামলাটি শাহজাহানপুরের আদালতে নিবন্ধন করা হয়।
প্রমাণ ও গ্রেফতার
প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া নিয়ে নানা ঝামেলা হয়। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে ডিএনএ পরীক্ষার মধ্যে প্রমাণ মেলে। শাহজাহানপুর পুলিশের সিনিয়র সুপারিনটেন্ডেন্ট এস আনন্দ বলেন, ‘এই মামলাটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। ওই নারী যখন মামলাটি নিয়ে সামনে আসলেন, আমরা অবাক হলাম। তবে ওই নারীর সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষার সুযোগটা আমরা নিলাম।’
মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পুলিশের পরিদর্শক ধর্মেন্দ্র কুমার গুপ্ত বলেন, ‘আমরা অভিযুক্তদের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করেছি। তাদের একজনের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর সন্তানের ডিএনএ’র মিল পাওয়া গেছে।’
৩১ জুলাই একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করা হয়। আরেক জনকে বুধবার পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
ধর্ষণের শিকার নারী বলেছেন, তার এই লড়াই এমন জঘন্য ঘটনার শিকার হাজারো নারীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
সূত্র: বিবিসি
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]