ফারুক রহমান, সাতক্ষীরা: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার সকাল ১১:০০ টায় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা),'র উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে “হাওর অঞ্চলে বৈষম্য ও অব্যবস্থাপনা” শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ধরা’র আহ্বায়ক রাশেদা কে. চৌধুরী’র সভাপতিত্বে এবং সদস্য সচিব শরীফ জামিল-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিতব্য এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান।
সভায় নির্ধারিত আলোচক হিসাবে বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) এর নির্বাহী পরিচালক ড. এম মোখলেসুর রহমান, হাওর উন্নয়ন আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, হাওর সংস্কৃতি অধ্যয়ন এবং গবেষণা একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সজল কান্তি সরকার, বারসিক এর পরিচালক পাভেল পার্থ এবং হাওর অঞ্চলবাসীর সমন্নয়ক জাকিয়া শিশির।
সভায় আরো বক্তব্য রাখেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী, মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস, সাবেক মৎস্য কর্মকর্তা সৈয়দ আলী আজহার, হাওরের ভূক্তভোগী আহ্লাদ খান, অঞ্জনা রাণী বিশ্বাস, বোরহান উদ্দিন, মেনন চৌধুরী প্রমুখ। আলোচনা সভার শুরুতে ধারনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন এসোসিয়েটস ফর ইনভেটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এআইআরডি) এর পরিচালক আব্দুল হাই চৌধুরী।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফরিদা আখতার বলেন, হাওর বাংলাদেশের সম্পদ। হাওরের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমরা জেনেছি, হাওর অঞ্চলে প্রতি তিন জনে একজন মানুষ গরীব। এ অঞ্চলে বৈষম্য টিকিয়ে রাখার কারণেই এই দারিদ্র তৈরি হয়েছে। ইজারা প্রথার কারণেই প্রকৃত দরিদ্র মৎসজীবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকৃত মৎসজীবীদের তালিকা তৈরি করছি। হাওরে অভয়াশ্রমের ঘোষণা দিতে পারলে আর পরিবেশকে রক্ষা করতে পারলে মৎস্য সম্পদ রক্ষা করা যাবে। প্রাকৃতিক মাছের উপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে হাওরে প্রকৃতিবান্ধব ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষা করেই এটা করতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজের সময় কীটনাশকের ব্যবহারের কারণেও মাছ ধ্বংস হচ্ছে। হাওরে কৃষিকাজে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমরা চায়না দুয়ারী জালের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। হাওর হলো মানুষের অধিকার। হাওরে ইজারা প্রথা বন্ধ করা প্রয়োজন।
রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, প্রকৃতিকে প্রকৃতির মতো থাকতে দিতে হবে। আমরা ইটনা-মিঠামইন সড়কের শেষ দেখতে চাই। পরিবেশ এবং হাওর ধ্বংসকারী এমন প্রকল্প যাতে আর না হতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। হাওরে নারীর নিরাপত্তার কথা আমাদের ভাবতে হবে। দরিদ্র হাওরাঞ্চলবাসীকে বাঁচাতে সোস্যাল সেফটিনেটের আওতায় ভিজিডি, ভিজিএফ, মাতৃত্বকালীন ভাতা, উপবৃত্তি ইত্যাদির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। হাওরে গবেষণার ক্ষেত্রে বিদেশী কনসালটেন্টের পরিবর্তে ইন্ডিজেনাস নলেজ এবং দেশীয় গবেষকের মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আন্ত:মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়।
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, প্রকৃত মৎসজীবীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। আমরা জানি এজন্য আমাদেরকে রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করতে হতে পারে। হাওর ও জলমহাল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রস্তাবিত নতুন আইনে নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণ ও জনসম্পৃক্ততা তৈরির লক্ষ্যে আইনের খসড়াটি অনলাইনে উন্মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রী সম্পদকে সরকারি জলমহাল বলে উল্লেখ করে ইজারা দেওয়াটা সাংঘর্ষিক। এটা পাবলিক প্রোপার্টি। তাই পাবলিক প্রোপার্টির ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, আমাদের একটা সমতাভিত্তিক উন্নয়ন প্রয়োজন। জলমহাল ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে না থাকে তাহলে এই সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় গতবছর ৩৭,১৫৪ কোটি টাকা কৃষিঋণ হিসেবে বিতরণ করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় প্রকৃত মৎসজীবীদের উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে চায়। প্রয়োজনে ইজারার টাকা কৃষি মন্ত্রণালয় পরিশোধ করবে যাতে ধনীরা জলমহাল ইজারা নিয়ে গরীব মৎসজীবীদের বঞ্চিত করতে না পারে। হাওরের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নে ২৫ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা করবে কৃষি মন্ত্রণালয়। সেখানে হাওরের বিষয়গুলো অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
শরীফ জামিল বলেন, হাওরের মৎসজীবীদের বাঁচাতে জলমহালভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠন করতে হবে। হাওর এবং জলমহালকে অবশ্যই প্রকৃত মৎসজীবীদের ব্যবস্থপনায় আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, হাওরের ভেতর দিয়ে তৈরি করা বাঁধ এবং রাস্তা বাতিল করতে হবে। আমরা জেনেছি, সীমান্তের ওপারে ইউরেনিয়াম মাইনিং হয় যার ফলে আমাদের জাদুকাটা নদীর মাছ মরে যায়। উজানের তেজস্ক্রিয় দূষণ বন্ধ করতে আমাদেরকে কাজ করতে হবে। ইজারা প্রথা পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মাত্র একশত কোটি টাকা রাজস্ব লাভের আশায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট করার কোন যুক্তি নেই।
নির্ধারিত আলোচনায় ড. এম মোখলেসুর রহমান বলেন, হাওরে টেকসই উন্নয়নের জায়গাতে বৈষম্য রয়েছে। হাওরে বৈষম্য দূরীকরণে টেকসই জলাশয় ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। হাওর ও জলমহালকে বাঁচাতে ওয়েটল্যান্ড ইনভেনট্রি করতে হবে।
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, জলমহালগুলো আগের মতো আর নাই। সমস্ত নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। হাওরকে বাঁচাতে নদী-নালা-খাল-বিলকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
সজল কান্তি সরকার বলেন, হাওরকে যারা লালন করেন আর যারা পালন করেন তাদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। বাংলাদেশ যদি মানব শরীর হয় তাহলে হাওর হলো তার কিডনি। এই কিডনি না বাঁচলে না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না।
পাভেল পার্থ বলেন, হাওর একটি বিশেষ প্রতিবেশ ব্যবস্থা। সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীগুলোর পানি ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে এসে হাওরে প্রবেশ করে। এই পানির সাথে আসে উজান থেকে ভেসে আসা মেঘালয় পাহাড়ের কারখানার দূষণ। উজানে বাঁধ তৈরি করে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে ভারত। তাই যৌথ নদী কমিশনের আলোচনায় হাওর অঞ্চলকে রাখতে হবে। হাওরের মাছকে বাঁচিয়ে রাখতে সোয়াম্প ফরেস্টকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
জাকিয়া শিশির বলেন, হাওরে ইজারা প্রথা রয়েছে। প্রকৃত মৎসজীবীরা ইজারা নিতে পারেন না। তারা মাছ ধরতে গেলে হামলা মামলার শিকার হচ্ছেন। মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আর হাওর হারাচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র। তিনি হাওরে নারী ও শিশুর অবস্থা উল্লেখ করে বলেন, হাওরের নারী ও শিশুরা নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। তারা মাঠে কৃষি কাজ করেন কিন্তু তাদের কোন স্বীকৃতি নাই। তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন, ধরা’র সহ-আহ্বায়ক এমএস সিদ্দিকী, সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক মো. নূর আলম শেখ, চুনতি রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়ক সানজিদা রহমান, ইআরডিএ এর নির্বাহী পরিচালক মনির হোসেন চৌধুরী, রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রমুখ।
আলোচনা সভায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে হাওর এবং হাওরাঞ্চলের জলমহালগুলোকে বাঁচাতে সকলকে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]