প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। নতুন শিক্ষা কাঠামোয় পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না।
পাশাপাশি নবম ও দশম শ্রেণিতে মানবিক, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা নামে বিভাগও তুলে দেওয়া হবে। এর বাস্তবায়ন ২০২৩ সাল থেকে শুরু হবে। সরকারের এই উদ্যোগকে ইতিবাচক বলছেন শিক্ষাবিদরা।
তারা বলেন, নতুন এই শিক্ষা কাঠামো বাস্তবায়নে মানসম্মত শিক্ষক গড়ে তোলাই বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ নতুন এ কাঠামোতে শিক্ষকরাই মূল ভূমিকা পালন করবেন।
কেমন হলো নতুন শিক্ষা কাঠামো-এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দা তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা এক কথায় অসাধারণ। এটাই শিক্ষাব্যবস্থার স্ট্যান্ডার্ড কাঠামো। এই রূপরেখার একটি ভালো দিক হলো এই কাঠামোতে শিক্ষার্থী যা শিখবে, তা বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবে।
নতুন এ কাঠামো বাস্তবায়নে মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন এ কাঠামো বাস্তবায়নে মানসম্মত শিক্ষক একান্ত প্রয়োজন।
কেননা শিক্ষকরা যদি সঠিকভাবে শিক্ষার্থীদের ডেলিভারি দিতে না পারে, তাহলে এটা কাগজেই থেকে যাবে। তাই শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের আর্কষণ করতে হবে এবং তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তাহমিনা আক্তার বলেন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই বাড়াতে হবে। শিক্ষকরা যদি এখনকার মতো নামমাত্র বেতন পান, তাহলে এ কাঠামো বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
একই কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাকাঠামো তৈরির উদ্যোগ অবশ্যই ভালো। এ কাঠামোতে পরীক্ষা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা ইতিবাচক।
তিনি আরো বলেন, নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব যাদের অর্থাৎ শিক্ষকদের এতে সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, অবশ্যই নতুন কাঠামোতে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে: কেন আমরা ২০১০ সালের শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারলাম না, এটা আগে খুঁজে বের করতে হবে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন শিক্ষা কাঠামো বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে।
শিক্ষকদের উন্নত জীবনযাপন নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নতুন শিক্ষা কাঠামো বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকরা।
তাই নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের জন্য আগে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে, যাতে তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারেন এবং পেশায় মনোযোগ দিতে পারেন। তা না হলে নতুন শিক্ষা কাঠামো বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা তৈরি করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
নতুন শিক্ষাক্রমে কী কী নতুনত্ব আছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।
গ্রাম ও শহরের মধ্যে যেন বৈষম্য না হয়, সে বিষয়টিও আমাদের বিবেচনায় ছিল। বর্তমান পদ্ধতিতে গ্রামের অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা বেশি সংখ্যায় মানবিক বিভাগে পড়ে। আর শহরের ধনী শিক্ষার্থীরা বেশি পড়ে বিজ্ঞানে। এতে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে।
তিনি আরো বলেন, নতুন পদ্ধতি হবে ফ্যাসিলিটি (সুবিধা) নির্ভর। অর্থাৎ ক্লাসে সময় ব্যয়ের চেয়ে শিক্ষার্থীকে বাইরের কাজে বেশি সময় দিতে হবে। ফলে তার গুণাবলিও বাড়বে অনেক বেশি।
নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের আর প্রচলিত নিয়মে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে না। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন।
এ বিষয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে পুরোটাই হবে শিখনকালীন মূল্যায়ন অর্থাৎ ধারাবাহিক মূল্যায়ন, যেটি হবে ১০০ শতাংশ। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে ভাগ আছে।
বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান- এ বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, আর সামষ্টিক মূল্যায়ন বা বর্ষ শেষে পরীক্ষা থেকে হবে ৪০ শতাংশ। কিছু কিছু বিষয় যেমন শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা ও শিল্পকলা এগুলোর ১০০ শতাংশই শিখনকালীন মূল্যায়ন হয়ে যাবে, অর্থাৎ হবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। আমরা এর মধ্যে ধারাবাহিক মূল্যায়নের যে পাইলটিং করেছি, সেখানেও কিন্তু অসাধারণ ভালো সাড়া পেয়েছি। এখানে আমরা অভিভাবকদেরও সম্পৃক্ত করেছি। শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী সকলের সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে আমরা খুব ভালো ফল পেয়েছি।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিকবিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলো আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। বাকি যে বিষয়গুলো-জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি, সেগুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন ১০০ শতাংশ। নবম ও দশম শ্রেণিতে গিয়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিকবিজ্ঞান- এই বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলোতে ১০০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন। আর দশম শ্রেণি শেষে পাঠ্যসূচির ওপরে পাবলিক পরীক্ষা।
আগে তো নবম-দশম মিলে একটা পাবলিক পরীক্ষা হতো, এখন দশম শ্রেণির শেষে পাবলিক পরীক্ষাটি হবে। অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষা যেটি হবে, সেটি শুধু ক্লাস টেনের কারিকুলামের ওপরে হবে।
দীপু মনি জানান, একাদশ ও দ্বাদশে আবশ্যিক বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৩০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষায় গিয়ে ৭০ শতাংশ পরীক্ষা দিতে হবে। প্রায়োগিক বা ঐচ্ছিক বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ১০০ শতাংশ। সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক ব্যাবহারিক ভিত্তিতেও শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]