বর্তমান সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। দলটিকে নির্বাচনে নিতে এবারও সরকারের পক্ষ থেকে নানা কৌশল নেওয়া হতে পারে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।
তাদের মতে, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ আছে। তাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইস্যুতে ছাড়ের প্রস্তাবও দেওয়া হতে পারে। আলোচনায় বসার আহ্বানও আসতে পারে। কিন্তু এবার অতীতের মতো আর ভুল করতে চান না তারা। সরকারের কোনো টোপেই পা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট রাজপথেই ফয়সালার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে এর বিকল্প নেই। সংকটের সমাধান না করে সরকার শেষপর্যন্ত একতরফা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হলে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও ভাবছেন দলের হাইকমান্ড।
দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও এমন বার্তা দিয়েছেন।
সোমবার রাতে তার সঙ্গে দেখা করতে যান নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। আলাপকালে তাকে খালেদা জিয়া বলেন, ষড়যন্ত্র করে নেতাদের বিপথগামীর চেষ্টা করবে সরকার। এক্ষেত্রে সজাগ থাকতে হবে; সতর্ক থাকতে হবে। সরকারের কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে জোরদার করতে হবে আন্দোলন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে মানুষকে একতরফা ভোট প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানাতে হবে।
এমনকি বিএনপিকে বাদ রেখে গায়ের জোরে নির্বাচন করে, সেক্ষেত্রে তা বয়কটের পরামর্শ দেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে তারা দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন করে আসছেন। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনও করা হয়।
২০১৮ সালে ভোটের আগে রাজপথের আন্দোলন জোরদার করা হয়। কিন্তু সরকার বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে নানা কৌশল নেয়। টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয় গণফোরাম সভাপতি সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে। বিএনপির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাকে সামনে এনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপ সবই ছিল সেই টোপের অংশ। শুরুতে বিএনপি সেই কৌশল বুঝতে পারেনি। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর সরকারের আচরণে তা স্পষ্ট হয়। কিন্তু সেই ফাঁদ থেকে বেরোনোর সময় তখন ছিল না।
ওই নেতারা মনে করেন, বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে এবারও নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে সরকার। দেওয়া হতে পারে নতুন টোপ। থাকতে পারে নানা প্রলোভনও। নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া, নির্বাচনি মাঠে সমতল পরিবেশ তৈরির আশ্বাস, নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে কাউকে আটক না করাসহ আরও কিছু বিষয়েও ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে।
ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রলোভন দেওয়া শুরু হয়েছে। রোববার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলে সংবিধান অনুযায়ী তাদের যতটুকু সম্ভব ছাড় দিতে অসুবিধা নেই। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে মন্ত্রণালয় দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকলে তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনকালীন সরকারে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে আমরা তার সঙ্গে সংলাপে বসেছিলাম। সেখানে তিনি যে কথা দিয়েছিলেন সেগুলোর একটাও রক্ষা করেননি। সুতরাং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায় আস্থা ও বিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠে না। আমরা মনে করি জনগণকে বিভ্রান্ত করার এটা আরেকটি চক্রান্ত। সরকারের কোনো চক্রান্ত বা কৌশলে বিএনপি এবার পা দেবে না।
তিনি বলেন, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে আমরা আন্দোলন করছি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া জনগণ অবাধে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। সেজন্যই আমরা নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবি করছি। সাধারণ জনগণও এ দাবির পক্ষে। সরকার তা মেনে না নিলে রাজপথে গণআন্দোলনের মাধ্যমেই তা আদায় করা হবে।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষপর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, দেশি-বিদেশি শক্তির চাপে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের নেতাকর্মীদের একটি অংশ এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেকের মধ্যে এখনো এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দলের হাইকমান্ডের এক মতবিনিময় সভায়ও বিষয়টি উঠে আসে। এক নেতা বলেন, রাজনীতির ময়দানে একটা গুঞ্জন রয়েছে, শেষ মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে বিএনপি এ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ সময় হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন না যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ধাকার কোনো সুযোগ নেই। এবার সরকারের কোনো টোপেই বিএনপি পা দেবে না। দলের এ অনড় অবস্থানের কথা সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অবহিত করতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্তের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করতে হবে। এ সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে না এখন থেকে প্রতিটি সভা-সেমিনারে দলের এ অবস্থান জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি এটাই চূড়ান্ত। নির্বাচনে নিতে সরকার যত কৌশলই গ্রহণ করুক সেদিকে আমরা পা বাড়াব না। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এ সরকারের পতন। রাজপথেই সেই ফায়সালা হবে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পেছনে সরকার ছাড়াও আরও কয়েকটি শক্তি কাজ করেছে। সময় স্বল্পতার কারণে তাদের সেই ফাঁদ বুঝতে পারিনি। যার মাশুল দিচ্ছে এ দেশের জনগণ। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার আমরা সতর্ক।
সূত্র: যুগান্তর
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]