নড়াইলে গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাইসাইকেলে যাতায়াত স্কুলযাত্রাকে শিক্ষার্থীরা আনন্দযাত্রা বলে মনে করেন।
নড়াইলের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাইসাইকেলে যাতায়াত দশম শ্রেণির ছাত্রী স্বর্ণালি বিশ্বাসের মা-বাবা দুজনই কৃষিশ্রমিক অন্যের কাজ করেন। স্বর্ণালিরা দুই বোন। তাদের চার সদস্যের সংসার চলে খেয়ে না খেয়ে। স্বর্ণালির স্কুল বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পর হেঁটে স্কুলে যেত। সপ্তম শ্রেণিতে উঠলে স্কুলের শিক্ষকেরা তাকে একটি বাইসাইকেল কিনে দেন। সেই থেকে বাইসাইকেলে করেই স্কুলে যাতায়াত করে স্বর্ণালি বিশ্বাস।
স্বর্ণালির মতো তার প্রতিবেশী সহপাঠী লেখা দত্তের সংসারের চিত্রও একই। সে–ও স্কুলের শিক্ষকদের কিনে দেওয়া বাইসাইকেলে স্কুলে যাওয়া–আসা করে। তারা দুজন বলছিল, শিক্ষকেরাই সাইকেল চালানো শিখিয়েছেন। সাত-আটজন একসঙ্গে বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে। গ্রামের মানুষ এ দৃশ্যে এখন অভ্যস্ত। কে কটু কথাবলে না বলে, তাদের কাছে স্কুলযাত্রাকে আনন্দযাত্রা মনে হয়।
‘বাইসাইকেলে আসায় সময়মতো ও দ্রুত স্কুলে আসা যায়। না হলে স্কুলে হেঁটে আসতে হতো। গ্রাম এলাকার রাস্তা, তাই সময়মতো ভ্যান পাওয়া যায় না। দু–একটা ভ্যান পেলেও ভাড়া অনেক বেশি, যা পরিবার থেকে দিতে পারে না। তাই নিয়মিত ও সময়মতো স্কুলে আসতে এ এলাকায় বাইসাইকেলের বিকল্প নেই।’ বলছিল স্বর্ণালি ও লেখা দত্ত। স্বর্ণালি ও লেখা দত্ত পড়ে গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটি ইউনিয়নের গুয়াখোলা গ্রামে ওই বিদ্যালয়।
উপজেলা সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার সীমান্তে স্কুলটির অবস্থান। বাঘারপাড়া উপজেলার কমলাপুর, রঘুরামপুর, দোগাছি, ঘোড়ানাছ, বাকড়ী ও কিসমতবাকড়ী গ্রামের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। এ ছাড়া নড়াইল সদর উপজেলার গুয়াখোলা, হাতিয়াড়া, বাকলি, মালিয়াট ও বেনাহাটী গ্রামের শিশুরা এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বাঘারপাড়া উপজেলার কমলাপুর গ্রামের সমাপ্তি গুপ্ত ও বৈশাখী গুপ্ত ওই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বিদ্যালয় থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে তাদের গ্রাম। স্কুল থেকে কিনে দেওয়া বাইসাইকেলে করে যাতায়াত করে তারা। তাদের মা-বাবাও অন্যের জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
তাদের দুজনের মা কনিকা গুপ্ত ও রুপা গুপ্ত বলছিলেন, বাইসাইকেল কিনে দেওয়ারও সামর্থ্য তাঁদের নেই। স্কুল থেকে সাইকেল কিনে না দিলে হেঁটে স্কুলে যেতে হতো, তাতে হয়তো পড়ালেখাই হতো না।
১৯৮৩ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় প্রত্যন্ত ওই গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ রাস্তাই ছিল কাঁচা। আশপাশ থেকে অল্প কিছু ছেলেমেয়ে এ স্কুলে পড়তে আসত। আস্তে আস্তে শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। দূর থেকেও ভর্তি হয় শিক্ষার্থীরা। ২০০৮ সালের দিকে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও কয়েকটি বাইসাইকেল কেনে। বাইসাইকেলে মেয়েরা স্কুলে আসতে থাকে। গ্রামের রাস্তায় মেয়েদের বাইসাইকেল চালানো দেখে সমালোচনা হতো। রাস্তার পাশ থেকে ছেলেরা টিপ্পনী কাটত, বলত আজেবাজে কথা। কিন্তু শিক্ষকেরা উৎসাহ দিতেন, অভিভাবকদের বোঝাতেন। শিক্ষকেরা গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ছাত্রীদের বাইসাইকেলে যাতায়াতে নিরাপত্তা দিতেন। এভাবে বাড়তে থাকে ছাত্রীদের বাইসাইকেলের সংখ্যা। ২০১২ সালে স্কুলের ফল ভালো হয় আশপাশের স্কুলের চেয়ে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চোখ পড়ে স্কুলটির প্রতি। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী। বাইসাইকেলে যাতায়াতেরও পরিমাণও বাড়ে।
শিক্ষক শিখা রানী মল্লিক, তাপস পাঠক, শিবানী রানী দাস, শেফালীবালা ভৌমিক, সুকান্ত গোস্বামী ও কৃষ্ণগোপাল রায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা জানান, বিদ্যালয়ে এখন ১৭২ জন ছাত্রী, ছাত্র ১৭৬ জন। এরা সবাই এখন বাইসাইকেলে যাতায়াত করে। এলাকাবাসী এখন এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অভিভাবক ও এলাকার সুধীজন এতে উৎসাহ দিচ্ছেন। উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন থেকে অনেক দরিদ্র ছেলেমেয়েকে সাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকদের পাশাপাশি দরিদ্র ছেলেমেয়েদের স্কুল থেকে সাইকেল দেওয়া হয়। চালানো শেখান অভিভাবকেরা ও স্কুলের শিক্ষকেরা।
স্কুল ছুটি হলে প্রায় সাড়ে তিন শ ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে বাইসাইকেলে স্কুল থেকে বের হয় ছবি: নারীমঞ্চ শিক্ষকেরা বলছিলেন, স্কুলের ফলাফল ও সহশিক্ষা কার্যক্রম ভালো হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। দারিদ্র্যের কারণে স্কুল থেকে বেতনও নেওয়া যায় না। কৃষিনির্ভর এ এলাকার নারী-পুরুষ খেতখামারে কাজ করে কোনোমতে সংসার চালান। সাইকেল দিয়ে উৎসাহ না দিলে এসব শিশুর হয়তো পড়াশোনাই হতো না। কারণ, দূর থেকে তারা হেঁটে নিয়মিত স্কুলে আসত না। পরিবহন হিসেবে আছে ভ্যান, তা–ও সময়মতো পাওয়া যায় না। আবার অধিকাংশ পরিবারের পক্ষে যাতায়াত খরচ বহনও সম্ভব নয়।
এলাকার লোকজন বলছিলেন, স্কুল ছুটি হলে প্রায় সাড়ে তিন শ ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে বাইসাইকেলে স্কুল থেকে বের হয়। এ সময় গ্রামের রাস্তার চেহারাই হয় অন্য রকম। অন্যান্য যানবাহন ও পথচারীরা দাঁড়িয়ে যায়, তাদের যাতায়াতে সহায়তা করে। একসঙ্গে বাইসাইকেলে যাতায়াত করায় মেয়েদের ঝুঁকিও কমে গেছে। নড়াইলের গুয়াখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাইসাইকেল শোভাযাত্রার আয়োজনকরেছিল। বর্ষবরণে ব্যতিক্রমী এই আয়োজনে ১১টি গ্রামের মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে তারা।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]