সম্প্রতি ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে মাছ ধরার একটি জাহাজে ঠাসাঠাসি করে বসে আছে রোহিঙ্গারা। আর তাদের নির্দয়ভাবে মোটা রশি দিয়ে পেটাচ্ছে পাচারকারীরা। মানবপাচারকারীদের হাতে নির্যাতনের এমন ভিডিও প্রকাশ খুবই বিরল।
এক মানবপাচারকারী ভিডিওটি ধারণ করে। পরে সে ওই দল থেকে পালিয়ে যায়। তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া মোবাইল সংগ্রহ করেন এক রোহিঙ্গা যুবক। সেই মোবাইলেই সন্ধান মেলে ওই ভিডিওর।
ভিডিওতে দেখা যায়, নৌকার উপরে, নিচে সব জায়গায় রোহিঙ্গারা গাদাগাদি করে বসে আছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। মানবপাচারকারীরা তার মধ্য দিয়ে চলাফেরা করছে। এক পর্যায়ে মানবপাচারকারীদের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু হয়। পরে মোটা রশি দিয়ে রোহিঙ্গাদের পেটানো হয়। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে একজন লাথি মারতে দেখা যায়।
মানবপাচার নিয়ে এএফপি মাসব্যাপী অনুসন্ধান করে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরেও অনুসন্ধান করে বার্তা সংস্থাটি। ১৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ ওসমান ওই নৌকায় ছিলেন।
ওসমান জানান, খাবার নিয়ে অভিযোগ করায় তাদের প্রহার করা হয়েছিল। ‘একটু বেশি ভাত এবং পানি চাওয়ায় তারা আমাদের এলোপাতাড়ি পেটাতে থাকে।’
ওসমানের প্রতিবেশি ১৯ বছর বয়সী এনামুল হাসান। তিনিও জাহাজে ছিলেন। তিনি বলেন, জাহাজে মানবপাচারকারীদের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়। তখন এক পাচারকারী পালিয়ে অন্য জাহাজে চলে যায়। যাওয়ার সময় তার কাছ থেকে ভিডিও ধারণ করা মোবাইলটি পরে যায়। পরে তিনি তা কুড়িয়ে নেন।
ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে তাদের বহনকারী জাহাজটি ছেড়ে যায়। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে এটি আবার বাংলাদেশে ফেরত আসে। ফেরত আসার কয়েক দিন আগে ভিডিওটি ধারণ করা হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসে এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে হাসান বলেন, মারধরের শুরু থেকে ভিডিও ধারণ করা হয়নি। মানবপাচারকারীদের হাতে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নিহত হয় বলেও জানান তিনি। ‘তারা নির্দয়ভাবে আমাদের মেরেছে। মাথায় আঘাত করেছে। কান ছিঁড়ে দিয়েছে। হাত ভেঙে দিয়েছে।’ বলেন হাসান।
হাসান এবং ওসমান জানান, মার খেয়ে, খাবারের অভাবে এবং অসুস্থ হয়ে জাহাজে থাকা ৪০ রোহিঙ্গা মারা গেছে। তাদের মধ্যে নারী-শিশু রয়েছে। মারা যাওয়ার পর তাদের সাগরে ফেলে দেয়া হয়।
তাদের অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই-বাচাই করতে পারেনি এএফপি। তবে জাহাজ থেকে জীবন নিয়ে ফিরে আসা তৃতীয় ব্যক্তিও একইরকম তথ্য দিয়েছে।
হাসান এবং ওসমান ওই ভিডিওতে রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে এএফপি। অন্য রোহিঙ্গাদের যখন মানবপাচারকারীরা আঘাত করছিলে তখন তাদের ভীড়ের মধ্যে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে।
হাসান বর্ণনা করেন, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু ক্রুরা কীভাবে কিছু রোহিঙ্গার প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যায়।
‘ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গারা ভাত এবং পানি সংগ্রহের জন্য জাহাজটিকে কোথাও থামানোর জন্য বলে। কিন্তু পাচারকারীরা আমাদের বলে চুপ থাক, তোদের জন্য কোন মাটি নেই। তারা বলে, কথা বললে মেরে ভাসিয়ে দেবে।’
‘তখন আমরা বুঝতে পারি এমন চলতে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। আমাদের ভিন্ন কিছু করা প্রয়োজন। আমাদের কাছে মনে হয়ে জাহান্নামে ছিলাম।’ বলেন হাসান।
‘তারপর আমরা ক্রুদের ওপর হামলা চালাই। কারণ আমাদের আর কিছু করার ছিল না। এটা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। আমরা পাচারকারীদের হুমকি দেই। যদি তারা আমাদের ভূমিতে না ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তাদের হত্যা করবো।’
‘তখন তারা আমাদের পাল্টা হুমকি দেয়। বলে, জাহাজে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। আমাদের পুড়িয়ে মারবে। যখন জ্যান্ত জ্বালিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেয়, তখন আমরা আবার চুপ হয়ে যাই।’ বলেন হাসান।
‘কয়েকদিন পরে ছোট একটি নৌকা আসে। পাচারকারীদের দু’জন পালিয়ে যায়।’ যোগ করেন হাসান।
হাসান বলেন, ‘জাহাজে আরও দুই পাচারকারী ছিল। তারা আমাদের বলেছিল, বিদ্রোহ করিস না। তোদের ইচ্ছেমতো আমরা নামিয়ে দেবো। কয়েকদিন পরে তারা আমাদের বাংলাদেশের কাছে ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এএফপি’র ভিডিওটি দেখতে এ লিংকে ক্লিক করুন
[embed]https://twitter.com/i/status/1338717986773876738[/embed]
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]