শুরুটা ২৮ অক্টোবর। সেদিন কী ঘটতে যাচ্ছিল ধারণা ছিল না বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের। একটি মহাসমাবেশ করে আল্টিমেটাম দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু দ্রুতই ভেস্তে যায় সব। সমাবেশ শেষ করারও সুযোগ পায়নি বিএনপি। অনেকটা তড়িঘড়ি করে ঘোষণা দেয়া হয় একদিনের হরতালের।
তবে পর্দার আড়ালে ঘটতে থাকে ভিন্ন ঘটনা। দ্রুতই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার করা হয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে।
কাছাকাছি সময়ে অভিযান চলে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ বিএনপি’র একাধিক নেতার বাসায়।
দ্রুতই নজরদারির মধ্যে নেয়া হয় তাদের।
চলতে থাকে নানা গুঞ্জন, আলোচনা। গুঞ্জন-আলোচনায় রয়েছে একাধিক তত্ত্ব। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন, সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। বিএনপি’র কাছাকাছি নামে নিবন্ধন পাওয়া দুটি দলে যোগদানের বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
তবে প্রাথমিকভাবে বিএনপি নেতারা সাড়া দেননি এতে।
এসব আলোচনার জন্য হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেয়া নিয়েও তৈরি হয় গুঞ্জন। বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ নতুন দল গড়তে পারেন- এমন খবরও চাউর হয়েছে। তবে তিনি এ খবর নাকচ করে দিয়েছেন। এটাও বলেছেন, তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিবেন না। একই কথা বলেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন। বলেছেন, বিএনপিতেই থাকবো। তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের প্রশ্নই উঠে না।
চলমান গুঞ্জন প্রসঙ্গে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি তো অসুস্থ। সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরার পর থেকেই বাসায় বিশ্রামে আছি। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। আমার কাছে কেউ কোনো প্রস্তাব নিয়ে আসেনি।
বিএনপি’র দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশে সংঘর্ষের পর থেকেই বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের নজরদারিতে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নানামুখী চাপে ফেলা হয় দলটিকে। সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তারে বাসায় বাসায় চালানো হয় অভিযান। বাসায় নেতাদের না পেয়ে গ্রেপ্তার করা হয় পরিবারের স্বজন, ব্যক্তিগত সহকারী, গাড়িচালক, অফিসের স্টাফদের। পুলিশের গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপি’র নেতাদের অনেকে এখন নিজের বাসায় থাকছেন না। গাঢাকা দিয়ে চলছেন।
২৮ অক্টোবর সংঘর্ষের পরদিন সকালেই গুলশানের বাসা থেকে বিএনপি মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের দিন একযোগে অভিযান চালানো হয় বিএনপি’র বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার বাসায়। মূলত তখন থেকেই তারা পুলিশের নজরবন্দিতে ছিলেন। ৩১ অক্টোবর শাহজাহানপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মির্জা আব্বাস ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। পরদিন গুলশানের পৃথক বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আমিনুল হককে। তাদের সবাইকেই বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে পাঠানো হয়।
মির্জা আব্বাসের স্ত্রী ও মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস জানিয়েছেন, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে একাধিকবার শাহজাহানপুরের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। তখন মির্জা আব্বাস বাসায় ছিলেন না। তাকে না পেয়ে বাসার কর্মচারীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে পুলিশ।
ওদিকে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর পরিবারের এক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৯ অক্টোবর থেকেই আমীর খসরুকে নজরবন্দি করে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই দিন সকালে বিএনপি মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের সময় আমীর খসরুর বনানীর বাসায়ও অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযানের সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। ওই সময় তিনি গুলশান-২ এ বোনের বাসায় অবস্থান করছিলেন। তখন থেকেই আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে নজরদারিতে রাখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চলছে
এদিকে ১ নভেম্বর মির্জা আব্বাসকে শাজাহানপুর থানার অস্ত্র ছিনতাই ও নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হয়। রিমান্ড শুনানির এক পর্যায়ে মির্জা আব্বাস আদালতের কাছে কিছু বলার অনুমতি চান। বিচারক অনুমতি দেয়ার পর মির্জা আব্বাস আদালতকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিএনপিকে শেষ করার একটা চেষ্টা চলছে। শুধু বিএনপিকে নয়, পুরো বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চলছে। একদিন বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করা হবে, অন্যদিন আওয়ামী লীগকেও নেতৃত্বশূন্য করা হবে। আপনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সিদ্ধান্ত আপনার। এরপর উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তার ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
ওদিকে বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এবার রাজধানীর পাশাপাশি জেলার শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে সিনিয়র নেতারা মাঠে না থাকলেও হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন দলটি কর্মীরা।
রবিবার থেকে ফের শুরু হচ্ছে দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ। বিএনপি দাবি করেছে, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা দায়ের হয়েছে ১১৩টি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের হামলা ও পুলিশের গুলিতে সারা দেশে ৯ জন বিএনপি নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এদিকে জামায়াত দাবি করেছে, গত এক সপ্তাহে দলটির দেড় হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত আটদিনে বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ছাড়াও গ্রেপ্তার করা হয়েছে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপি মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহিরউদ্দিন স্বপন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সভাপতি শরীফুল আলম, ঢাকা উত্তর বিএনপি’র সদস্য সচিব আমিনুল হক, ঢাকা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারকে।
এদিকে গত কয়েক মাসের মধ্যে বিএনপি’র আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- ঢাকা উত্তর বিএনপি’র আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি’র সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন, যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ রবিউল ইসলাম রবি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরব, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, সাবেক যুবদল নেতা এসএম জাহাঙ্গীর, গোলাম মওলা শাহীনকে।
তথ্যসূত্র: মানবজমিন
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]