শাহ জাহান আলী মিটন, সাতক্ষীরা: ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরায় র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সাতক্ষীরা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিউটের আয়োজনে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে র্যালি শুরু হয়ে একই স্থানে এসে র্যালী শেষ হয়। পরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরের সভাপতিত্বে এসময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মঈনুল ইসলাম মঈন, জেলা কৃষি অফিসার মোঃ সাইফুল ইসলাম, সাতক্ষীরা উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামসুর নাহার রত্না, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন মশু, জেলা তথ্য অফিসার জাহারুল ইসলাম, সদর উপজেলা কৃষি অফিসার মনিরুজ্জামান প্রমুখ।
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসটি বার্ষিক ইভেন্ট যা পৃথিবীতে জীবনকে সমর্থন করার জন্য মাটির তাৎপর্য প্রচার করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে। এটির লক্ষ্য কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জীব বৈচিত্র্য, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং আরও অনেক কিছুতে মাটি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে সম্পর্কে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়কে সচেতন করা। মাটির স্বাস্থ্যের উপর গুরুত্ব কেন্দ্রীভূত করা এবং মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার পক্ষে সমর্থন করার জন্য প্রতি বছর ৫ ডিসেম্বর বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস (World Soil Day) পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়- “মাটি ও পানি : জীবনের উৎস” (Soil and water: a source of life)।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় মৃত্তিকা বিজ্ঞানী শামসুন নাহার রত্না বলেন, সারা পৃথিবীতে মানুষ যে সকল খাবার খায়, তার অন্তত শতকরা ৯৫ ভাগ আসে মাটি হতে। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ৯৩০ কোটি মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে শতকরা ৬০ ভাগ বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে হবে। পৃথিবীর পানির মাত্র ২.৫% হল সুপেয় পানি এবং বাকি ৯৭.৫% হল ভূগর্ভস্থ পানি ও বরফ। সুপেয় পানির ০.৩%-এর ও কম অংশ পাওয়া যায় নদীতে, হ্রদে ও বায়ুমণ্ডলে এবং তার চেয়েও ন্যূনতম অংশ পাওয়া যায় বিভিন্ন জীবের শরীর ও উৎপাদিত পণ্যে।
১৯৭১ সালে চাষযোগ্য জমি ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর, খাদ্য উৎপাদন হতো ১ কোটি ১০ লক্ষ টন। বর্তমানে চাষ যোগ্য জমি ৮৮ লক্ষ ২৯ হাজার হেক্টর, খাদ্য উৎপাদন ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ টন (চাল)। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তুলনায় চাষ যোগ্য জমি হ্রাস পেয়েছে অর্ধেকের ও বেশি কিন্তু তার বিপরীতে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ৩ গুণের বেশি।
কৃষি বান্ধব সরকারের সঠিক নীতি প্রণয়নের ফলে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২ এর আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষির উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি গত উৎকর্ষ তার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনে সীমিত মৃত্তিকা সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার কোন বিকল্প নেই।
মৃত্তিকা বিজ্ঞানী আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬৮,৭৬০ হেক্টর (০.৭৩%) আবাদি জমি অনাবাদি জমিতে পরিণত হচ্ছে। যেখানে গৃহ নির্মাণ হচ্ছে ৩০,৮০৯ হেক্টর জমিতে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ (শতকরা প্রায় ৩৪ ভাগ) মাটি অবক্ষয়ের শিকার। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আশংকা করছে যে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ অবক্ষয়ের এই হার নব্বই শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮ টি জেলার ১০৭টি উপজেলার মাটি ও পানি বিভিন্ন মাত্রায় লবণাক্ততায় আক্রান্ত। ১৯৭৩ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮ লক্ষ ৩৩ হাজার হেক্টর। ২০০০ সালে বেড়ে গিয়ে ১০ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টরে দাড়িয়েছে এবং ২০১০ সালে লবণাক্ততায় আক্রান্ত জমির পরিমাণ ১০ লক্ষ ৫৬ হাজার হেক্টর। লবণাক্ততার কারণে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে কৃষক ভাইয়েরা ফসল আবাদ করতে পারে না।
জমিতে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করার ফলে এলাকায় লবণাক্ততা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবার অন্যতম একটি কারণ। লবনাক্ত তার মান বৃদ্ধ্বির পাশা পাশি জমির উর্বরতার মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। মুখ্য পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও গন্ধক এবং গৌণপুষ্টি উপাদান দস্তা ও বোরন এর ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। লবণাক্ততা, নদী ভাঙন ইত্যাদি কারণে প্রতি বছর এক দিকে কৃষি জমি যেমন কমে যাচ্ছে অপর দিকে ভেজাল সার ও অপরিকল্পিত ভাবে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ দুটোই ক্ষতি হচ্ছে। লবণাক্ত এলাকায় ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধিও জন্য খামার পুকুর প্রযুক্তি, মাল্চ ব্যবহার ও কলস সেচের মাধ্যমে বিভিন্ন মাদা ফসল এর আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব মাটি হলো খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি।
তাই মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ন। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার বিকল্প নেই। তাই আমাদের উচিত মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যাতে মাটির কাঙ্খিত উর্বরতা ধরে রাখা যায় এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
আলোচনা সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শেখ মইনুল ইসলাম মঈন বলেন, মৃত্তিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এই সম্পদ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একদিকে মাটির পুষ্টি উপাদানের মাত্রা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের মৃত্তিকা সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
জেলা কৃষি অফিসার মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, মাটিকে আমাদের সম্পদে পরিণত করতে হবে। তবেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশের মাটিকে সোনার চেয়ে খাঁটি বলা হয় অথচ সুষ্ঠু ব্যবস্থা পনার অভাবে এই মাটি আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই আমাদের উচিত মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা যাতে মাটির কাঙ্খিত উর্বরতা ধরে রাখা যায় এবং ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]