দেশে তিন সপ্তাহ ধরে নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হারও ঊর্ধ্বমুখী। করোনায় মৃত্যুও বাড়তে শুরু করেছে। ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে শনাক্ত ও মৃত্যু বেশি বাড়ছে। এসব জেলায় করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সেখানকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে।
চলতি মাসে দেশের করোনা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তারা বলছে, দেশে করোনার ভারতীয় বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ ঘটছে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিস্তারের মূল ক্ষেত্র হয়ে আছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হলো এর মাধ্যমে রোগটি দ্রুত ছড়ায়। মৃত্যুও বেশি হয়। সীমান্তবর্তী হাসপাতালে করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যাগুলো রোগীতে পূর্ণ হয়েছে এরই মধ্যে। ফলে রোগীদের বড় অংশকে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা এবং খুলনা, বাগেরহাট, নাটোর, নোয়াখালী ও কক্সবাজার জেলায় করোনার ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেছে।
এই জেলাগুলোর অনেক হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা যায়নি। রয়েছে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সংকট।
গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, সীমান্তের আরো ২১টি জেলায় সংক্রমণের ব্যাপকতা বাড়ছে। এসব জেলা থেকে করোনাসংক্রান্ত বিষয়ে টেলিমেডিসিন সেবা নেয়ার সংখ্যা বেড়েছে।
গত ৮ মে ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির শরীরে করোনার ভারতীয় নতুন ধরন শনাক্তের খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এরপর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ হঠাৎ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ মে ওই জেলায় লকডাউন ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন। গত দুই সপ্তাহ ধরে সীমান্তবর্তী সাতটি জেলায় সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হতে থাকে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সাতক্ষীরা জেলায় সম্পূর্ণ ও সাতটি জেলায় এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেয়া হয়।
করোনা শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নতুন করে খুলনার পাইকগাছা, নাটোর সদর ও সিংড়া পৌরশহরে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
এছাড়া যশোর ও অভয়নগর পৌরসভাকে বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, লকডাউন আরো আগেই ঘোষণা করা উচিত ছিল। গত মে মাস থেকেই এসব অঞ্চলে সংক্রমণ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। তখন লকডাউনের দাবি করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সীমান্তবর্তী বেশকিছু জেলায় লকডাউন আরোপ করা হলেও তা চলছে ঢিলেঢালাভাবে। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তেমন কোনো কড়াকড়ি নেই। এ কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে লকডাউন জোরদার করতে হবে।
এসব জেলায় সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষা ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তি যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাদের চিহ্নিত করা) কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যথাযথভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা করতে হবে। নয়তো পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় গত বছরের ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন, ভেন্টিলেটর স্থাপন ও উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশ দেন। কিন্তু এতদিনেও জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ স্থাপন না করাকে স্বাস্থ্য বিভাগের চরম ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তারা।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেখানে প্রতিটি জেলায় আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে এতদিন পার হয়ে গেলেও নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি কেন? এটা আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের চরম ব্যর্থতা।’
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত শুক্রবার (৪ জুন) সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে তথ্য প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, দেশে ডেল্টা বা ভারতীয় ভেরিয়েন্টের সামাজিক বিস্তার ঘটেছে।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি এলাকা থেকে করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৫০ জনের নমুনা সিকোয়েন্সিং করে ৮০ শতাংশ বা ৪০টি নমুনায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে।
এছাড়া ১৬ শতাংশ বা আটটি নমুনায় বিটা ভেরিয়েন্ট বা সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট এবং বাকি ৪ শতাংশ বা দুটি নমুনায় অপরিচিত দুটি ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। বিষয়টিকে আইইডিসিআর উদ্বেগজনক হিসেবে অভিহিত করে মানুষকে আরো সতর্ক থাকার কথা বলেছে।
বিশেষজ্ঞরা যেকোনো রোগ বিস্তারের সবচেয়ে বড় হাব হিসেবে দেখছেন ঢাকাকেই। তাদের মতে, দেশে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সীমান্তবর্তী এলাকায় আগে ছড়ালেও তা যেভাবে ঢাকায় এসে পৌঁছল, ঠিক সেভাবেই এখন তা ঢাকা মহানগরীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও ঢাকার বাইরে দ্রুত বিস্তারের বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় এখন যেভাবে শনাক্ত ও মৃত্যু তুলনামূলক কম আছে, সেটা আগামী দুই সপ্তাহে পাল্টে গিয়ে আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে জরুরি হয়ে পড়েছে একাধারে সংক্রমণ রোধ ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাকে প্রস্তুত রাখা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে যাতে কোনোভাবেই কেউ ঢাকা বা অন্য জেলায় যেতে না পারে, সেজন্য আমাদের পরামর্শ অনুসারে স্থানীয় প্রশাসনকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে। এরপরও মানুষ নানা কৌশলে ওই এসব এলাকা থেকে বের হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়ালে তা ঠেকানো কঠিন ব্যাপার। এখান থেকে আবার সারাদেশে ছড়ানোর ঝুঁকি থেকেই যায়। মানুষ সতর্ক না হলে আইন প্রয়োগ করে এমন মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সব ক্ষেত্রে সহজ বিষয় নয়।’
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]