মিয়ানমারে চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সংঘর্ষে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা ক্রমেই ভীতিকর হয়ে উঠছে। অজানা আশঙ্কায় সীমান্ত বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। প্রশাসনের খোলা আশ্রয়কেন্দ্রসহ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তারা আশ্রয় নিচ্ছেন। বুধবারও কক্সবাজারের হোয়াইক্য সীমান্তের ওপারে নতুন করে সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বিজিপির আরও ৬৩ সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি সদস্যসহ ৩২৭ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
সীমান্ত এলাকাগুলো পরিদর্শন করে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেছেন, সীমান্ত পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ করে বিজিবি সদস্যরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হবে না।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বাসিন্দারা জানান, মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের সংঘাতে ব্যবহৃত মর্টারশেলের আঘাতে হতাহতের ঘটনায় লোকজন ঘরবাড়ি ছাড়ছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী তুমব্রু বাজারপাড়া, কোনাপাড়া, মাঝেরপাড়া, ঘুমধুমপাড়া, জলপাইতলীর কয়েক শতাধিক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রসহ দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসনের খোলা উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ৪০টি পরিবারের ২৪৩ জন সদস্য আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া দেড় শতাধিক পরিবারের সদস্যরা আত্ময়স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। তবে ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো কেউ যায়নি। আশ্রয়কেন্দ্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ছয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয় সরিয়ে নিতে অস্থায়ী দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আড়াইশ মানুষ অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে দেড়শ পরিবার চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে সীমান্তবাসীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, বুধবার মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে তেমন গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। তবে জানতে পেরেছি-আরাকান বিদ্রোহীরা সীমান্ত রক্ষী বিজিপির তুমব্রু, ঘুমধুম, ডেকুবুনিয়া ক্যাম্প দখল করেছে। সেখানে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন শঙ্কায় সীমান্তবাসী নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন।
বুধবার সীমান্ত এলাকাগুলো পরিদর্শনকালে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে আমরা ধৈর্য ধারণ করে, মানবিক দিক থেকে এবং আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে পরিস্থিতি মোকাবিলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, অবৈধভাবে আর একজনকেও বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে বিজিবি সদস্যদের তিনি সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।
একইদিন সকালে কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের (৩৪ বিজিবি) দায়িত্বপূর্ণ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত এবং তৎসংলগ্ন বিওপি পরিদর্শন করেন বিজিবি মহাপরিচালক। সীমান্তে দায়িত্বরত সব পর্যায়ের বিজিবি সদস্যদের তিনি খোঁজখবর নেন এবং তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
এ সময় দেশমাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাইকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সীমান্তে উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি সদা তৎপর থাকার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে অত্যন্ত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করায় বিজিবি সদস্যের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় বিজিবি মহাপরিচালকের সঙ্গে বিজিবি সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার, রামু সেক্টর কমান্ডার ও কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়কসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরও ৬৩ বিজিপি সদস্যের আশ্রয় : মিয়ানমারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বিজিপির আরও ৬৩ সদস্য বাংলাদেশে এসেছেন। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে উলুবনিয়ার সীমান্ত দিয়ে তারা পালিয়ে আসেন।
বিজিবির সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম জানান, পালিয়ে আসা বিজিপির সদস্যদের অস্ত্র জমা নিয়ে বিজিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত বিজিপি, সেনা ও সাধারণ নাগরিকসহ ৩২৭ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের নিরস্ত্র করে হেফাজতে রাখা হয়েছে।
টেকনাফ–সেন্টমার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অস্থির পরিস্থিতির কারণে কক্সবাজারের টেকনাফ–সেন্টমার্টিন নৌরুটে আগামী শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পর্যটকবাহী সব জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
বুধবার এ ঘোষণা দেয় জেলা প্রশাসন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এডিএম ইয়ামিন হোসেন।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর সংঘাতের আঁচ এসে পড়ছে মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের এলাকাগুলোতে।
এর আগে এদিন সীমান্তে চলমান উত্তেজনার কারণে সেন্টমার্টিনে নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুল জামান সিদ্দিকী।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে মিয়ানমারের বিজিপির সদস্যদের অবস্থা পরিদর্শন করার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তে গোলাগুলি ও মর্টারশেল ছোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এমন অবস্থায় নাফ নদী হয়ে পর্যটনকেন্দ্র সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ।
পর্যটন মৌসুমে প্রচুর মানুষ সেন্টমার্টিনে যাতায়াত করছেন। এ প্রেক্ষাপটে, সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন বিজিবির মহাপরিচালক।
বিজিবি মহাপরিচালকের মন্তব্যের পরপরই নৌ-রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলেই সেন্টমার্টিনে যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নতুন করে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিতে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে নির্দেশনা দেয় বিআইডব্লিউটিএ।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]