যাবজ্জীবনে ৩০ বছর, রায়ে ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’ বললে বাকি জীবন জেলে: আপিল বিভাগ
যাবজ্জীবনের প্রাথমিক অর্থ দণ্ডিতের বাকি জীবন হলেও দণ্ডবিধি ও ফৌজদারী কার্যবিধির আওতায় সাজা হয় ৩০ বছর। তবে আদালত নির্দিষ্ট করে আমৃত্যু কারাদণ্ড বলে দিলে আসামিকে বাকি জীবন জেলেই কাটাতে হবে বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাবাস’ আপিল বিভাগেরই এমন রায় ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ দাবি করে আসামিপক্ষ যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিল, সে আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারকের ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দিয়েছে।
আবেদনটি সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে জানিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সংক্ষিপ্ত রায়ে বলেন,
প্রাথমিক অর্থে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মানে হল, দণ্ডিত ব্যক্তি তার স্বাভাবিক জীবনের বাকি সময় কারাভোগ করবেন।
দণ্ডবিধির ৪৫ এবং ৫৩ ধারার সাথে দণ্ডবিধির ৫৫, ৫৭ ধারা এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫(ক) মিলিয়ে পড়লে যাবজ্জীবনের সাজা কমে ৩০ বছর কারাদণ্ডের সমতুল্য হয়।
তবে আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনাল যখন কোনো আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়, তিনি কার্যবিধির ৩৫(ক) ধারার (রেয়াতি) সুবিধা পাবেন না।
রায় ঘোষণার সময় আসামিপক্ষে আদালতে যুক্ত ছিলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও আইনজীবী শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “যাবজ্জীবন মানে আসামিকে সর্বোচ্চ ৩০ বছর সাজা খাটতে হবে। তবে আদালত যদি আমৃত্যু সাজা দেয়, তাহলে সেটাই গণ্য করতে হবে উল্লেখ করে রিভিউ রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ।“
যাবজ্জীবনে ৩০ বছর- এ নিয়ম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মামলায় দণ্ডিত আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেও স্পষ্ট করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, “যাবজ্জীবন মানে কতদিন, আসামিকে কতদিন সাজা ভোগ করতে হবে এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। আমরা সে ব্যপারে রিভিউ পিটিশন করে বলেছিলাম, বর্তমান আইনের বিধান অনুযায়ী যাবজ্জীবনে ৩০ বছর হবে। কারণ ৩০ বছর যদি না হয়, তাহলে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৫(ক)সহ অন্য আইনের বিধানগুলো এবং জেলকোড, সব বাতিল হয়ে যাবে।
“আজকের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, যাবজ্জীবন বলতে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবন যতদিন, ততদিন। কিন্তু আইন অনুযায়ী যাবজ্জীবন দণড্প্রাপ্ত একজন আসামির ৩০ বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। যদি আদালত বা ট্রাইব্যুনাল বিশেষভাবে আদেশ দেন, তাহলে আমৃত্যু জেলখানায় থাকতে হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, “রায়ে আমরা মোটামুটি সন্তুষ্ট। তবে আমৃত্যু সাজাটা মানবতাবিরোধী এবং আমৃত্যু সাজা যদি থাকে, তাহলে জেলাখানায় ওল্ডহোম করতে হবে। একটি মানুষ যখন অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে যাবে, তখন তার চলাফেরার শক্তি থাকবে না। তখন তার সেবা- শুশ্রুষার বিষয়টিও আদালতকে বিবেচনা করতে হবে।
“আমি এখনও মনে করি, আমৃত্যু সাজার প্রশ্ন যখন আসবে, আদালত থেকে এমন একটা আদেশ আসবে একসময়, যখন প্যারোলের বিধান থাকবে। একটি লোক যখন অথর্ব হয়ে যাবে, বৃদ্ধ হয়ে যাবে, চলাফেরায় অক্ষম হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে বর্তমানে যে বিধান রয়েছে, সরকার তাকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু এ রায়ের পর যখন আমৃত্যু সাজা হবে, সেখানে সরকারের সেই ক্ষমতাও (প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা) থাকবে না। তাই এটাকে প্রয়োজনবোধে আবার পুনর্বিবেচনার জন্য দ্বিতীয়বার আবেদন করতে পারি।”
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ গত বছর ১১ জুলাই শুনানি শেষে রিভিউ আবেদনটির রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছিল।
রিভিউ শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত এ বিষয়ে পাঁচ অ্যামিচি কিউরির বক্তব্য শোনে। তারা হলেন আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, আবদুর রেজাক খান, মুনসুরুল হক চৌধুরী ও এ এম আমিন উদ্দিন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে আমৃত্যু কারাবাস জানিয়ে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছিল, তা ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ দাবি করে ২০১৭ সালে এই রিভিউ আবেদন করে আসামিপক্ষ।
তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, এক হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচারে (ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে) দেওয়া ওই রায় আপিল বিভাগেরই আগের আরেকটি রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সেদিন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ওই রায়ের কারণে আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে ‘অনিশ্চয়তার’ সৃষ্টি হয়েছে। ‘সঠিক বিবেচনায়’ ওই রায় দেওয়া হয়নি। বিভ্রান্তি দূর করার জন্য পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হয়েছে।
২০০১ সালে সাভারের ব্যবসায়ী জামান হত্যা মামলায় দুই আসামির আপিল শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নেতৃত্বাধীন চার বিচারকের আপিল বেঞ্চ ওই রায় দেয়। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল।
সেখানে বলা হয়, দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা ও ৪৫ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে আমৃত্যু কারাবাস। এর ফলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত সবাইকে আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হবে।
আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন জমা দিয়ে সেদিন ওই সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ ৩০ বছর সাজা। এরপর আসামি রেয়াত পেলে ওই সাজার সময় আরও কমে যাবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫(ক) ধারা অনুযায়ী সাজার মেয়াদ থেকে বিচারিক সময়ের হাজতবাসের সময়ও বাদ যাবে।
খন্দকার মাহবুব আরও বলেছিলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ২০১৩ সালে এক রায়ে বলেছিল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ হল সাড়ে ২২ বছর কারাদণ্ড।
আপিল বিভাগের ওই রায় ও আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় বিচারপতি সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের অপর রায় আসে; সেখানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’ বলা হয়।
“আপিল বিভাগের আগের রায় বাতিল না করেই এ রায় দেওয়া হয়েছে। ফলে রায়ের ব্যাখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ (ক) ধারার কার্যকারিতা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির ক্ষেত্রে স্থগিত করা সমীচীন হয়নি। এটা দূর হওয়া প্রয়োজন,” বলেছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।
জামান হত্যা মামলায় আপিলের রায়ে বলা হয়েছিল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সাজা মওকুফ (রেয়াত) পাওয়ার কোনো অধিকার নেই। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি অন্য কোনো সুবিধা (রেয়াত) পাওয়ার দাবি করতে পারে না।
ব্রিটিশ আমলে করা আইন ও কারাবিধির বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে বিচারপতি এস কে সিনহা আদালতের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে ‘বিভ্রান্তির’ কথা বলেছিলেন।
২০১৬ সালের ২৬ জুন গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলতে আপনারা মনে করেন ৩০ বছর। ধরে নেয়, সব জায়গায়। প্রকৃতপক্ষে এটার অপব্যাখ্যা হচ্ছে। যাবজ্জীবন অর্থ হল একেবারে যাবজ্জীবন, রেস্ট অফ দ্য লাইফ।”
এরপর আদালতে দেওয়া রায়েও একই মত প্রকাশ করেন তিনি। ওই রায় প্রকাশের পরদিন তার ব্যাখ্যায় তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, আপিলে যাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, শুধু তাদের ক্ষেত্রেই আমৃত্যু কারাগারে কাটাতে হবে। আর বিভিন্ন মামলায় যাদের যাবজ্জীবন সাজা হবে, তাদের মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে না। দণ্ডবিধি অনুযায়ী ৩০ বছর জেল খেটেই বের হবেন তারা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)