যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি ধনকুবেরদের সন্দেহজনক সম্পত্তি লেনদেন কেন্দ্র করে নতুন করে আলোচনায় এসেছে শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নাম। লন্ডনের নাইটসব্রিজ, সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটার কিংবা মেফেয়ারের বিলাসবহুল এলাকায় গত এক বছরে অন্তত ২০টি সম্পত্তি হস্তান্তর, বিক্রি বা পুনঃঅর্থায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- যেগুলোর সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ঢাকা থেকে তদন্তাধীন একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পরিবার।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পতনের পর ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পদ স্থানান্তরের চেষ্টা করছেন। এতে প্রশ্ন উঠেছে- কীভাবে এসব লেনদেন ঘটেছে, আর লন্ডনের আইনি প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শকদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াই বা কতটা কার্যকর ছিল?
অভ্যুত্থানের পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও যুক্তরাজ্যের প্রপার্টি বাজারে বাংলাদেশের বিতর্কিত ব্যক্তিদের সক্রিয়তা থামেনি। তাই ঢাকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন এনসিএকে (ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি) আরও সম্পত্তি জব্দের অনুরোধ জানিয়েছে।
চৌধুরী, রহমান ও সোবহান পরিবার- তিন প্রধান কেন্দ্রবিন্দু
বৃহৎ সম্পত্তি হস্তান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, বেক্সিমকোর ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান শাহ আলমের পরিবারের সদস্যরা।
গার্ডিয়ান জানায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী শেখ হাসিনার শাসনামলে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন। তার মালিকানাধীন সম্পত্তির সংখ্যা ছিল ৩০০’রও বেশি- ছোট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে বিলাসবহুল টাউনহাউজ পর্যন্ত। গত মে মাসে এনসিএ তার ১৭ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করে।
তদন্তের আওতায় রয়েছেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরীও। ভূমি নিবন্ধন দপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত জুলাইয়ে তিনি লন্ডনের রিজেন্টস পার্কের পাশে ১ কোটি পাউন্ড মূল্যের একটি টাউনহাউজ বিক্রি করেন। এরপর আরও তিনটি সম্পত্তির পুনঃঅর্থায়নের আবেদন করা হয়েছে।
চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ডেভেলপারের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে, যিনি যুক্তরাজ্যে একাধিক প্রপার্টি চুক্তিতে সক্রিয় ও যার ওপর এরই মধ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাংলাদেশি আদালত।
অন্যদিকে, বেক্সিমকো পরিচালনাকারী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তারা মেফেয়ারের গ্রসভেনর স্কয়ারের সাড়ে ৩ কোটি পাউন্ড মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্টসহ একাধিক সম্পত্তির মালিক। এনসিএ গত মাসে এসব সম্পত্তিও জব্দ করেছে।
বসুন্ধরা পরিবারের বিপুল সম্পদ লেনদেনের পথে
বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের মালিকানাধীন নাইটসব্রিজের চারতলা একটি টাউনহাউজ গত এপ্রিলে বিনামূল্যে হস্তান্তর করা হয় ব্রুকভিউ হাইটস লিমিটেড নামে একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানের কাছে। এরপর সম্পত্তিটি আবার নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি হয় প্রায় ৭৩ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে, যার পরিচালকের কোনো প্রকাশ্য প্রোফাইল নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি মালিকানা লুকানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত প্রতিষ্ঠান।
পরিচিত আরেক সদস্য সাফিয়াত সোবহানের মালিকানাধীন সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটারের ৮০ লাখ পাউন্ড মূল্যের একটি বাড়ির লেনদেনের জন্য দুটি আবেদন জমা পড়েছে।
সোবহান পরিবারের কেউ মন্তব্যে সাড়া না দিলেও আগে তারা অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছিল, তারা সব ধরনের আইনি লড়াইয়ে প্রস্তুত।
ঢাকার আহ্বান: যুক্তরাজ্য যেন আরও সম্পদ জব্দ করে
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে কেউ কেউ বলছেন ‘প্রয়োজনীয় শুদ্ধি অভিযান’, কেউ বলছেন ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও পাচারকৃত সম্পদ ফেরত আনার কমিটির প্রধান আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এ ধরনের লেনদেন বন্ধ না করলে যথাযথ তদন্ত অসম্ভব হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, আমরা জানি, এখন অনেকেই তাদের সম্পদ বিক্রি করতে চাইছেন। আমরা যুক্তরাজ্যের সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, আরও সম্পদ যেন দ্রুত জব্দ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনও এনসিএর কাছে একই অনুরোধ জানিয়েছেন।
যুক্তরাজ্যে আইনি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন
গার্ডিয়ান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তদন্তে উঠে এসেছে, এই বিতর্কিত সম্পত্তির লেনদেনের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একাধিক আইনি ও হিসাবরক্ষক সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।
যেমন- রহমান পরিবারের সম্পত্তির ব্যাপারে আইনি প্রতিষ্ঠান জাসওয়াল জনস্টন ও মেরালি বিডলের বিরুদ্ধে লেনদেন সহজ করার অভিযোগ উঠেছে। জাসওয়াল জনস্টনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না ও যাচাই-বাছাইকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। অন্যদিকে, মেরালি বিডল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, এ ধরনের পেশাদার প্রতিষ্ঠানের উচিত- তাদের মোয়াক্কেলদের সম্পদের উৎস গভীরভাবে যাচাই করা ও সন্দেহজনক কার্যক্রম থাকলে তা অবিলম্বে পুলিশকে জানানো। নাহলে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুতই বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মিশে যাবে।
যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি ও সর্বদলীয় দুর্নীতি এবং করসংক্রান্ত পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান জো পাওয়েল বলেন, ইতিহাস বলছে- যদি দ্রুত সম্পদ জব্দ না করা হয়, তবে সেগুলো সহজেই হারিয়ে যেতে পারে। আমি এনসিএ’র বর্তমান পদক্ষেপকে স্বাগত জানাচ্ছি, তবে খুব দ্রুত তাদের জাল আরও বড় করতে হবে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]