কলম থেকে কলাম
রুদ্ধশ্বাসের দুইমাস ও চীনা প্রশাসনের করোনা মোকাবেলা
চীনের সবচেয়ে বড় উৎসব ‘Chinese New Year’ বা ‘চীনা নববর্ষ’। জানুয়ারী মাসে শুরু হয়ে প্রায় একমাসের ও বেশি সময় জুড়ে চলে এই উৎসবের তোড়জোড়। শেষ হয় ফেব্রুয়ারী মাসের ‘Lantern Festival’ লণ্ঠন উৎসব বা ‘Spring Festival’ বসন্ত উৎসবের মাধ্যমে। এই একমাস ধরে আকাশে চলে আতশ বাজির ফোয়ারা। এই সময়টাতে এত বাজি পুড়ানো হয় নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মত না। বিগত বছরগুলোর ন্যায় এবার ও সব বিশ্ববিদ্যালয় গুলো নববর্ষ উদযাপনের জন্য শীতের ছুটি ঘোষনা করেছিল ১১ ই জানুয়ারি। সাধারনত ছুটির সপ্তাহ খানিক আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গুলো খালি হতে শুরু হয় এবং ছুটি শুরুর মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাস খুব দ্রুত খালি হয়ে যায়। সব ছাত্রছাত্রীরা একটা করে চাকা ওয়ালা লাগেজ নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে পড়ে পরিবারের সাথে ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যে। ডরমেটরি থেকে দলে দলে বাড়ীর উদ্দেশ্যে বের হওয়া চীনা ছাত্রছাত্রীদের এটা খুবই চিরচেনা দৃশ্য। কয়েক দিন ধরে চলে শুধু যাওয়া আর যাওয়া, ছুটি শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে চোখে পড়ে ফেরার দৃশ্য।
তাদের চোখমুখে বাড়ী ফেরা বা ফিরে আসা নিয়ে কোন অনিশ্চয়তার ছাপ দেখা যায়না। পরিবহন টিকিট নিয়ে নেই কোন কালোবাজারি বা জালিয়াতির সুযোগ বরং সবার যাতায়াত কে নির্বিঘ্ন এবং সাশ্রয়ী করতে ছুটির সময়ে বিভিন্ন বিমান কোম্পানি, ভ্রমণ সংস্থা, পরিবহন কোম্পানি গুলো টিকিটের সাধারন মূল্যের উপর উপরন্তু ছাড় দিয়ে থাকে। সেজন্য বিশেষ দিনগুলোতে পরিবারের সবাই একসাথে ছুটি কাটাতে বা দূরে কোথাও ভ্রমণ করতে তেমন কোন সমস্যায় পড়েননা চীনারা।
দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এবছরের ছাত্রছাত্রীদের সেই ফেরার দৃশ্য চোখে পড়তে অনেক সময় লেগেছে। শীতের ছুটি শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই শুরু হয় চীনে মহামারী করোনার তান্ডব এবং তা চলতে থাকে প্রায় ৪ মাসের ও অধিক সময় ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। করোনা ভাইরাসের থাবায় চীন সহ পুরো বিশ্ব থমকে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাসের উৎসস্থল চীন হলেও আশার বাণী হল চীন এখন আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। সমস্ত রাস্তা ঘাট, শপিং মল, দর্শনীয় স্থানগুলো ফিরে পেয়েছে আগের সেই চির চেনা রূপ। সকল অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সবখানেই এখন স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে। প্রশ্ন জাগাটায় স্বাভাবিক এত দ্রুতই কিভাবে করোনা ভাইরাস কে মোকাবেলা করেছে চীনা সরকার? করোনা মহামারিকে মকাবেলা করতে যে পদক্ষেপ গুলো চীনা প্রশাসনকে নিতে দেখেছিলাম তারই কিছু নমুনা আজ ভাগাভাগি করলাম।
সেদিন (গত ২৪ শে জানুয়ারি) আমরা গিয়েছিলাম ‘New Year’ এর নৈশ ভোজে। বছরের ওই দিনটাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নৈশ ভোজের আয়োজন করে থাকে এবং সেখানে ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র ছাত্রীরা তাদের ফ্যামিলি মেম্বর সহ নিমন্ত্রিত হয়। আমরা ও এর ব্যত্যয় হইনি। আমার স্ত্রী এবং মেয়ে অন্তুর ভিতরে কিছুদিন আগে থেকেই ওই নৈশ ভোজে যাওয়া নিয়ে একটু বেশী তোড়জোড় লক্ষ্য করেছিলাম। বলতে গেলে ওদের চীনে আসার পরে ওইটায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আয়োজিত কোন ফরমাল অনুষ্ঠান তাই একটু বেশিই আনন্দিত ছিল ওরা। আমি গেল ২০১৯ সালের নৈশ ভোজে বিদেশী বন্ধুদের সাথে ভালোই মজা করেছিলাম। ছিল বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রী বা তাঁদের পারিবারিক সদস্যদের উপস্থতিতে একটা ছোট্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। টেবিলে সজ্জিত হরেক রকমের খাবার দাবার খেতে খেতে ওই অনুষ্ঠান উপভোগ, বন্ধুদের সাথে খোশ গল্প, সাথে ক্ষনে ক্ষনে খুব কাছ থেকে আতশ বাজির ঝলকানি দেখা সত্যিই খুব উপভোগ্য ছিল। তারই ধারাবাহিকতা এবং এবারই প্রথম পরিবার নিয়ে নৈশ ভোজে অংশ গ্রহন নিঃসন্দেহে একটু হলেও ভাল লাগা অনুভূতি কাজ করছিল। তাই কনকনে শীতের মধ্যেও আমরা ভারি শীতের পোশাক পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্যাম্পাসে হাজির হয়েছিলাম।
উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দেশীয় কিছু মানুষের সাথে দেখা করে নৈশ ভোজের আগের সময়টা পার করব। সেই উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে আগেভাগেই পৌঁছে একের পর এক কল দিলাম তুর্য, হাবিবা এবং নীলিমা কে। ওরা সবাই এখানে পিএইচডি করছে। ফোন দেওয়ার পরে বুঝলাম তারা নৈশ ভোজে অংশগ্রহনে অতটা আগ্রহী না সেজন্য ডরমেটরি থেকে বাইরে আসতেও চাইল না। আমি জোরাজুরি করলাম না। প্রথম কলে তুর্য এবং হাবিবা আসতে তেমনটা আগ্রহ প্রকাশ না করায় অন্তুর মন এর মধ্যে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। কেননা তুর্য আঙ্কেল আর হাবিবা আন্টির সাথেও অন্তুর কম যায়না। কিছুদিন আগে অন্তুর জন্মদিনে গিয়েছিলেন এই আঙ্কেল আন্টি পরিবার, নীলিমা আন্টি সহ আরও অনেকে। নীলিমার সাথে অন্তুর খুবই ভালো বোঝাপড়া। সেই দেশ থেকে আসার সময় অন্তুর সাথে নীলিমার প্রথম পরিচয় বিমান বন্দরে। তারপর থেকে তারা দুজনে খুবই ভালো বন্ধুত্ব বনে গেছে। তাই নীলিমা আন্টির কথা শুনলেই অন্তুর মনে খুশির জায়গা ধরেনা।
তুর্য এবং হাবিবা না করার পরে এবার নীলিমা কে কল দিলাম। নীলিমা কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসল। আমরা যেখানে নৈশ ভোজের আয়োজন করেছে সেখানে গেলাম। এবারের পরিবেশ গতবারের চেয়ে অনেক ভিন্ন ছিল। কেউ কারো ধারে কাছে ভিড়তে চাইছে না। সবার মুখে কেমন একটা মলিনতা, একটা ত্রাস, অজানা আতংক। কেউ কেউ মুখে মাস্ক পরেছেন। কারন ইতোমধ্যে হুবেই প্রদেশের উহান শহরে শুরু হয়ে গেছে করোনার আক্রান্তের তান্ডব, মৃত্যুর মিছিল। নৈশ ভোজের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তেমন কারও উপস্থিতি দেখলাম না। নেই কোন আতশ বাজির কারসাজি এবং কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। খাবারের আয়োজন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ ক্যান্টিনে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও খুবই কম। গতবারের তিন ভাগের এক ভাগ হবে সব মিলিয়ে।
আমরা নীলিমা এবং মায়ানমারের মিয়াথ সবাই একটা টেবিলে বসে রাতের খাবার শেষ করলাম। যেহেতু বিভিন্ন দেশের মানুষের অংশগ্রহনে অনুষ্ঠানটা হয় তাই আয়োজকরা আগে থেকেই সব ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে কি পছন্দ বা অপছন্দ করে সেটার একটা তালিকা তৈরি করেন। সব দেশের মানুষ যেন তৃপ্তি সহকারে খেতে পারেন সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আয়োজকরা ২৫-৩০ রকমের খাবারের মেন্যু তৈরি করেন। খাবার পরিবেশনে থাকে বুফে ব্যবস্থা। আমরা সবাই ভালোই পেটপুরে খেয়ে বাসায় চলে আসলাম। অবশ্য আসার আগে অন্তু তার নীলিমা আন্টি এবং মিয়াথ আন্টির সাথে বেশ কিছুক্ষণ খেলে নিয়েছিল।
সেইদিনের বাসায় ফেরার পর থেকেই শুরু হল একের পর এক নিষেধাজ্ঞা। পরিবার নিয়ে আমাদের ওইটায় ছিল শেষ বাইরে যাওয়া। এর পরে পরিবার নিয়ে বাইরে গিয়েছি প্রায় দুই মাসের ও অধিক পরে। খুব আতঙ্ক আর রুদ্ধশ্বাসের ভিতর দিয়ে পার করেছি আমরা ভয়াবহ সেই দুই মাসের প্রতিটা মুহূর্ত। ২৬ শে জানুয়ারি জানতে পারলাম আমাদের শহরে ‘কোভিড-১৯’ পজেটিভ রুগি পাওয়া গেছে। বুঝতে বাকি রইল না বিপদ বেশি দূরে নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উইচ্যাট (চীনাদের ব্যবহৃত সর্বাধিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম) গ্রুপের সতর্কবার্তা আরো ভয় ধরিয়ে দিল। বারবার আমাদের জানাতে লাগলেন বাইরে না যাওয়ার জন্য এবং একসাথে বেশি বেশি করে খাবার কিনে জমিয়ে রাখার জন্য। কারন যেকোন মুহূর্তে আমাদের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে।
তার ঠিক দুইদিন (২৮ শে জানুয়ারি) পর থেকে চলাচলের উপর খুব কড়াকড়ি শুরু হল। আমাদের কমিউনিটির গেটে বসানো হল আলাদা পোশাক পরা অনেক সিকিউরিটি গার্ড। তাদেরকে বুঝিয়ে অনুমতি নিয়ে বাইরে যাওয়াটা ছিল অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। বেশীরভাগ চীনাদের ইংরেজি বোঝানো অনেক কষ্টকর তাই নিতান্ত প্রয়োজনে পথে বের হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীদের নিজের প্রয়োজনীয়তা না বোঝাতে পেরে অনেকবার বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছি। তাই পরে বাইরে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিই। আমাদের বাসার গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা সুপার সপ আছে সেখান থেকে নিত্যপ্রয়োজন মিটিয়েছি সেটাও সপ্তাহে একবার। ওই একবার গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বেশী করে কিনে জমিয়ে রাখতাম। তখন আমাদের ভিতরে খাবারের ব্যবহারেও যথেষ্ট মিতব্যায়িতার লক্ষন প্রকাশ পেত। বেশীরভাগ জিনিস অনলাইনে অর্ডার করতাম কিন্তু আগে যেটা ১/২ দিনে পৌছাত সেটা এসেছে এক সপ্তাহের বেশি সময় নিয়ে।
অজানা ভয় পিছু ছাড়েনি। পরিবারের কেউ যদি একবার হাঁচি দিতাম তখনই হিসাব করতাম শেষ কবে আমি বাইরে গিয়েছিলাম। আঙ্গুল টিপে টিপে গুনে দেখতাম চৌদ্দ দিন পুরতে এখনো কতদিন বাকি। শুধু এটাই ভাবতাম একবার যদি আক্রান্ত হই তাহলে কি পরিস্থিতিতেই না পড়ব আমরা। না জানি এদের ভাষা না জানি কিছু। কে দেখবে বাচ্চাটার, এসব নানান চিন্তায় প্রতিটাক্ষন পার করেছি। প্রতিদিন আক্রান্ত, মৃত্যু বেড়েই চলেছিল। ভাবতাম কবে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে পরিত্রাণ মিলবে? আবার কি আমরা আগের সেই দিনগুলি ফিরে পাব নাকি এভাবেই গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে মাসের পর মাস?
চীন সরকারের নজর কাড়ার মত কিছু নিয়ম নীতি
কিছুদিন পর থেকে পরিস্থিতির একটু উন্নতি দেখতে পেলাম। আমি দেখেছিলাম চীন সরকারের নজর কাড়ার মত কিছু নিয়ম নীতি। যেটা ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এমনিতেই চীনারা অনেক শৃংখলিত তাতে আবার সরকারের নজরদারি। সবমিলিয়ে তাদের প্রতি স্যালুট জানানোটায় শ্রেয়। প্রশাসন প্রতিটা কমিউনিটিতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন। কমিউনিটিতে বসবাসকারী সবাইকে দেওয়া হয়েছিল অস্থায়ী আইডি কার্ড। আমরা যে এই কমিউনিটিতে থাকি তার প্রমান সরূপ আমাদের বাসার মালিক সেটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন অনেক কাগজপত্র জমা দেওয়ার প্রেক্ষিতে। সেটা নিয়ে মাঝেমধ্যে বাইরে বাজার করার জন্য বের হওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কমিউনিটির গেট থেকে বের হওয়া আর ঢোকা ছিল অনেক কষ্টের। কারন নিরাপত্তা বাহিনী কে যদি আমার প্রয়োজনীয়তা সুস্পষ্ট বোঝাতে না পারতাম তাহলে তারা যেতে দিতেন না। একদিন বের হয়ে দেখলাম পুরো রাস্তা জন মানবহীন। যে রাস্তায় মিনিটে শত শত গাড়ী চোখে পড়ে সেখানে ৫ মিনিটে ও একটি গাড়ী দেখতে পেলাম না। অল্প দূরত্ব পরপর শুধু পুলিশ আর পুলিশ। ৫ কিমি রাস্তা পার হতেই অন্তত ৫ বার গায়ের তাপমাত্রা মেপে দেখছেন তাঁরা। সব খোলা মার্কেট বন্ধ। সুপার মলে প্রবেশের সময় স্বয়ংক্রিয় থার্মাল স্ক্যানারে তাপমাত্রা মাপছে। দেখেছিলাম নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে কিছু নার্স করোনা ভাইরাসের টেস্ট কিট এবং মেডিকেল সরঞ্জামাদি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যদি কারো শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দেখছেন তখন সাথে সাথে নমুনা নিয়ে সেখানেই মেডিকেল টিম পরীক্ষার ব্যবস্থা করছেন। যেটা ছিল সত্যিই নজর কাড়ার মত।
করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত প্রতিদিনের খবরাখবর পেতাম মোবাইলের একটা অ্যাপের মাধ্যমে। সেখানে পয়েন্ট টু পয়েন্ট আপডেট দেওয়া হত। গত ২৪ ঘন্টায় কতজন আক্রান্ত, কতজন সুস্থ, কতজনের মৃত্যু হয়েছে এবং সেটা গতকালের চেয়ে আজ কতজন বেশি বা কম। যদি দেখতাম গতকালের চেয়ে আজ একটু কমেছে তখন মনে অনেক আশার সঞ্চার হত। অনেকে দেশে যেতে বলেছিল কারন এখানকার প্রায় সব বাংলাদেশীরা এখন দেশে। কয়েকটা জিনিস ভেবে দেশে যাওয়ার কতা চিন্তা করিনি। এক. দেশে গেলেই কি বেঁচে যাব? নাকি সাথে করে দেশকে আরো বিপদে ফেলব? দুই. পরিবার নিয়ে দেশে যেতে গিয়ে যদি পথে কোন পরিবহন থেকে নিজেরা আক্রান্ত হই?
অনেক কিছু শিক্ষণীয়
আমাদের দেশ বা পার্শ্ববর্তী অনেকে দেশের জনগণের চীন আর চীনাদের সম্পর্কে অনেক খারাপ ধারনা আছে। কিন্তু আমি বলব এদের থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। আমি যতটুকু দেখেছি এরা অনেক সাহায্য পরায়ণ এবং সুশৃংখল হয়। আমার কিছু বন্ধু আছে যারা এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁরা করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে আমাদের সার্বক্ষণিক খোঁজ নিয়েছেন। বারবার বলেছেন কোন সাহায্য লাগলে তাঁদেরকে যেন বিনা সঙ্কোচে জানাই। আমার পিএইচডি সুপারভাইজার সবসময় আমার সাথে দেখা করেছেন, খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং নানাভাবে সাহায্য করেছেন। মহামারীর সময়ে আমারা বাইরে বের হতে পারিনি ঠিকই কিন্তু আমাদের ইন্টারন্যাশনাল কলেজ সার্বক্ষণিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। তাঁরা আমাদের কমিউনিটির গেটে এসে ফ্রি তে মাস্ক, থার্মোমিটার সহ আরও কিছু দরকারি জিনিস পৌছে দিয়ে গেছেন। আমরা সুস্থ আছি সেটা প্রতিদিন উইচ্যাট গ্রুপে আপডেট দিতে হত। প্রতিদিন শরীররে তাপমাত্রা মেপে তাঁদেরকে জানাতে হত।
প্রায় পাঁচ মাস হলো ফুজিয়ান প্রদেশে নতুন কারো করোনা আক্রান্তর খবর পাওয়া যায়নি তবুও রয়েছে নানান সতর্কতা
আজ প্রায় পাঁচ মাস হল আমাদের প্রদেশে (ফুজিয়ান) নতুন কারো করোনা আক্রান্তর খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু আজ ও এনারা হাল ছাড়েননি। আমরা প্রতিদিন গ্রুপে আপডেট দিচ্ছি, বাইরে গেলেও কতটুকু সময় কোথায় কি কাজে গিয়েছিলাম সেটা জানাচ্ছি। সুপার মার্কেট গুলো এখনো তাপমাত্রা দেখেই প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কোন পাব্লিক প্লেসে মাস্ক ছাড়া কর্তৃপক্ষ যেতে দেয়না। মাস্ক আনতে ভুলে গেলে বা না থাকলে সেখানেই কেনার ব্যবস্থা আছে। বাস, ট্রেন, মেট্রোরেল, সুপার মল, পার্ক সব ভ্রমণে মাস্ক পরা ব্যতীত কাউকে প্রবেশের অনুমতি নেই। সম্প্রতি চীনের রাজধানী বেইজিং সহ কিছু প্রদেশে বিদেশ থেকে আসা কিছু ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষায় উপসর্গ বিহীন কিছু করোনা ভাইরাস পজেটিভের খবর পাওয়া গেছে। তখনই কর্তৃপক্ষ তড়িৎ গতিতে সেসব ব্যক্তিকে আইসোলেশন করা সহ তার মোবাইল ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির উপস্থিতির সর্বত্র এলাকা জীবাণুনাশক স্প্রে, তার সংস্পর্শে আসা বাকী অন্য সবার নমুনা পরীক্ষা সহ এটা নিয়ন্ত্রণে যত পদক্ষেপ নেওয়ার আছে কর্তৃপক্ষ নিয়েছেন। ফলে ভাইরাস আর বিস্তার লাভ করতে পারিনি। ভাইরাসের উৎসস্থল চীনে হলেও চীনারা ভাইরাস মোকাবেলায় সবচেয়ে সফলতা দেখিয়েছেন। তাঁরা বুঝেছিলেন প্রতিরোধ বা ভাইরাসের বিস্তার রোধ ছাড়া এটা থেকে পরিত্রান মিলানো খুবই কষ্টকর সেজন্য তার ফল ও তাঁরা হাতেনাতে পেয়েছেন।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় সবখানেই এই ভাইরাসের রাজত্ব ছড়িয়ে গেছে। যে দেশ এটাকে হাল্কা ভাবে নিয়েছে সে দেশই দিয়েছে অনেক বড় ভুলের খেসারত। বন্ধুপ্রতিম পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রশাসনের পাশাপাশি জনগণের স্বদিচ্ছা সবচেয়ে বেশী দরকার। করোনা ভাইরাসকে সমূলে নির্মূল করতে জনসচেতনতার কোন জুড়ি নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু করলে এটা থেকে পরিত্রান মিলবে, না হলে আগামী কিছুদিনের ভিতর শীত শুরু হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ বিশেষজ্ঞরা সবাই আশংকা করছেন শীতে আবার ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে।
এখনকার হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রতিদিন হাজারের উপরে ব্যক্তি সনাক্ত হচ্ছে। পুরো দেশে এখন এটা ছড়িয়ে গেছে। জনগণের কাছে অনুরোধ একটু ভেবে দেখবেন, সতর্কতা অবলম্বন করেও একজন থেকে কয়েক কোটি হতে সময় লাগেনি আর এক হাজার থেকে পুরো বাংলাদেশ হতে কয়েকদিনের ব্যাপার মাত্র। পত্রিকাতে দেখেছি চীনের উহান শহর অবরুদ্ধ করতে সেখানকার মেয়র নাকি আট ঘন্টা অপেক্ষা করেছিলেন আর সেই আট ঘন্টায় পুরো চীন সহ বিশ্বের কয়েকটা দেশে এটা ছড়িয়ে পড়েছিল।
আমরা স্বপ্ন দেখি করোনা মুক্ত সুস্থ সবল সুন্দর পৃথিবীর। যেখানে থাকবেনা কোন আতঙ্ক, কোন অনিশ্চয়তা, আর মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি। থাকবে শুধু বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতা, বাঁচার স্বাধীনতা। ফিরে যাব আগের সেই সুন্দর দিনগুলোতে। যে দিন বেশী দূরে নয়। সবাই সেই আশায় বুক বেঁধে, নিজের অবস্থান হতে সচেতন হয়ে এই আশাটুকু করতেই পারি।
লেখকঃ
অজয় কান্তি মন্ডল
গবেষক
ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এন্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি
ফুজো, ফুজিয়ান, চায়না।
ও
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ
ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫, বাংলাদেশ।
Email: [email protected]
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)