মেহেদী হাসান শিমুল: সাতক্ষীরায় আদালতপাড়া ও রেজিস্ট্রি অফিসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কথিত এনজিও ‘সাদিক জনকল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অফিসে তালা ঝুলিয়ে উধাও হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আব্দুল হামিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রয়েছেন পলাতক।
সাতক্ষীরা জজ কোর্ট সংলগ্ন এক আইনজীবী বাসাবাড়ির নিচতলায় অফিস ভাড়া নিয়ে শুরু হয় এই প্রতারণার আসর। বাহ্যিক চাকচিক্যে ভরা অফিসে ব্যাংকের মতোই রেকর্ডবুক, প্যাড, চেকবই ও সঞ্চয়পত্র সাজিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলে কোটি টাকার অঙ্কে লেনদেন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২০ সালের মাঝামাঝি অফিস খোলার পর থেকেই সাদিক জনকল্যাণ সমিতি সাতক্ষীরা আদালতের কর্মকর্তা, আইনজীবী, আইনজীবী সহকারী ও রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীদের লক্ষ্য করে উচ্চ লভ্যাংশ ও সহজ ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে 'ডিপিএস', 'এফডিআর' ও 'সঞ্চয়পত্র' খুলতে গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করেন। প্রথম দিকে নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান করলেও, ২০২৫ সালের জানুয়ারির পর থেকে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায় তাদের কার্যক্রম। গত ৫ আগস্টের পর হঠাৎ অফিসে তালা পড়ে যায়- তখনই প্রকাশ্যে আসে এই সমিতির কোটি টাকার প্রতারণার কাহিনি।
জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আব্দুল হামিদের পর সবচেয়ে বেশি সদস্য সংগ্রহে ভূমিকা রাখেন ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক। এছাড়া সুন্দরী নারী কর্মী পিয়া সুলতানা, খাদিজা খাতুন, শান্তা, রিনা প্রমুখকে সামনে রেখে গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা হয়। আদালতপাড়ার অফিস রুমগুলো একসময় যাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল, এখন তাদের কাউকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
একজন আইনজীবীর সহকারী নাম প্রকাশ না করে জানান, আমি ১২ লাখ টাকা এফডিআর করেছিলাম। প্রথম দিকে কিছু লভ্যাংশ পেয়েছি, পরে অফিস বন্ধ করে উধাও হয়ে গেছে। ফোনে যোগাযোগও সম্ভব হচ্ছে না।
অবসরপ্রাপ্ত আদালত পেশকার আব্দুল মুকিত বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এখন অফিসে তালা। আমার কাগজপত্র সবই আছে- প্রয়োজনে মামলা করব।
জানা যায়, জজ কোর্ট ও রেজিস্ট্রি অফিস এলাকার প্রায় তিন শতাধিক বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে কোটি টাকারও বেশি অর্থ সংগ্রহ করেছে এ প্রতারক চক্র।
একজন গ্রাহক জানান- তাদের সবকিছুই ছিল পরিকল্পিত। নারী কর্মীরা গ্রাহকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলত। নতুন গ্রাহকের টাকা দিয়ে পুরনো গ্রাহককে লভ্যাংশ দেওয়া হতো। যখন নতুন টাকা আসা বন্ধ হয়, সবাই পালিয়ে যায়।
সাতক্ষীরা সদর সমবায় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, সাদিক জনকল্যাণ সমিতি নামের কোনো অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান আছে কিনা জানা নেই। রেকর্ড দেখে বলতে পারবো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূল হোতা আব্দুল হামিদ দেবহাটা উপজেলার আতাপুর গ্রামের মৃত মাদার ঢালির ছেলে। ২০২৪ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে অফিস বন্ধের পর থেকেই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এক প্রতিবেশী জানান- আগে মাঝেমধ্যে বাড়ি আসত, এখন মাসের পর মাস দেখা যায় না। কেউ বলে বিদেশ গেছে, কেউ বলে ঢাকায় লুকিয়ে আছে।
সাদিক জনকল্যান সমিতির দ্বারা প্রতারিত গ্রাহকদের কাছে এফডিআর বই, ডিপিএস রসিদ, সঞ্চয়পত্র ও চেকের কপি রয়েছে। তারা এসব প্রমাণসহ আইনি পদক্ষেপ করবেন বলে জানিয়েছেন।
সাদিক জনকল্যাণ সমিতির প্রতারণা শুধু অর্থ আত্মসাৎ নয়- এটি বিশ্বাস, আস্থা ও আর্থিক নিরাপত্তার ওপর চরম আঘাত। নিয়ন্ত্রণহীন সমবায় ও এনজিও কার্যক্রমের কারণে সাধারণ মানুষ আজও এমন ফাঁদে পড়ছে, যার কোনো সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা নেই।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]