জলাবদ্ধ এলাকায় পতিত জমিতে পানিফল সেঙ্গারা চাষ করে সফলতা পেয়েছে সাতক্ষীরার চাষিরা। ফলে চীনের খাদ্য তালিকার জনপ্রিয় এই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যপণ্যটি সাতক্ষীরাসদর উপজেলাসহ প্রত্যেকটি উপজেলায় বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হচ্ছে। সুস্বাদু এ ফলটি এখন জেলার কালীগঞ্জ, দেবহাটা, সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, আশাশুনি, শ্যামনগর ও তালা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ হচ্ছে জোরেসরে। অধিক লাভ হওয়ায় প্রতি বছর এর পরিধিও বাড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য নারী ও পুরুষের। আশ্চর্যের বিষয় হলো অল্প পুঁজিতে কম দামে বেশি ফলন লাভ এমন ফসল খুব কম আছে দেশে।
সাতক্ষীরায় উৎপাদিত ফলটি এখন জেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। চাষিরা অক্লান্ত পরিশ্রম আর গবেষণা করে জলাবদ্ধ জায়গা সোনার ফসলে রূপ দিয়েছে এ ফল। আর সেই সাথে তাদের প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে জেলা কৃষিখামার বাড়ি। অতি পরিচিত পানিফলটি শুধু গ্রামেই নয় শহরের ফুটপাতের ফলের দোকানে স্থান করে নিয়েছে।
সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ মহাসড়কের সখিপুর, ডেল্টা মোড়, কালিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন সড়ক, সাতক্ষীরা শহরের খুলনা রোড মোড়, পাকাপোল ব্রিজ, বড় বাজারসহ, সাতক্ষীরা-কলারোয়া সড়কের দুধারেসহ জেলার সব খানে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে এ পানিফল। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পানিফল বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকায়। পাইকারিতে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২২ টাকায়। পানিতে জন্মে বলে পানিফল নামে এটি পরিচিতি লাভ করেছে।
তবে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে থেকেই চীন দেশে পানিফলের চাষ হয়ে আসছে। বিগত দর্শক থেকে বাংলাদেশও পানিফলের চাষ হয়ে আসছে বিচ্ছিন্নভাবে। তবে পানিফল চাষে সফলতা আসায় জলাবদ্ধ যুক্ত সাতক্ষীরা জেলায় বাণিজ্যিক ভাবে এর চাষ শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। পানি ফল দেখতে অনেকটা সিঙ্গাড়ার মতো বলে সাতক্ষীরার লোকরা এ পানিফলকে বলে পানি সেঙ্গারা । কাঁচা অবস্থায় এ ফল খাওয়ার প্রবণতা বেশি। আবার সিদ্ধ করে, রান্না করে কিংবা প্রক্রিায়াজাত করেও অনেকেই খেয়ে থাকে।
দেবহাটা উপজেলার পানি ফলের পাইকারী ব্যবসায়ী কামটা গ্রামের শাহিনুর রহমান জানান, পানিফল চাষের মৌসুম আসার আগেই অর্ধ শতাধিক চাষিকে আমি বিনিয়োগ করেছি। ফলন আসার পর সেই চাষিদের নিকট থেকেই আমি ফল সংগ্রহ করছি।
কলারোয়া উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামের ইয়াকবর আলী জানান, চলতি মৌসুমে তিনি সাত বিঘা জমিতে পানি ফলের চাষ করেছেন। তিনি আরো জানান, এ এলাকায় পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে অন্য কৃষি কাজ করা সম্ভব হয় না। যার কারণে গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধ জমিতে এ পানিফল চাষ শুরু করেছি। এতে বাড়তি লাভ হচ্ছে। খরচ কম আবার উৎপাদন ও বিক্রি বেশি। এবছর তিনি আড়াই লাখ টাকারও বেশি পানিফল বিক্রি করতে পারবে বলে আশা করেন তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলায় চলতি মৌসুমে ১২০ হেক্টর জমিতে পানিফলের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২১ হেক্টর, কলারোয়া উপজেলায় ২১ হেক্টর, তালা উপজেলায় দুই হেক্টর, দেবহাটা উপজেলায় ২৩ হেক্টর, কালিগঞ্জ উপজেলায় ৫০ হেক্টর, আশাশুনি উপজেলায় দুই হেক্টর ও শ্যামনগর উপজেলায় এক হেক্টর জমিতে। গত মৌসুমের চেয়ে চলতি মৌসুমে পঁাচ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ বেড়েছে। জেলায় ১৬০০ জন কৃষক পানিফলের চাষাবাদ করেছেন বলে সূত্র জানায়।
পুষ্টি বিশেজ্ঞরা বলছে, পানিফলে প্রায় ৯০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেড, ৬০ শতাংশ শর্করা, রাইবোফ্লেবিন, ভিটামিন বি, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আমিষ, ভিটামিন আছে। পুষ্টিমানের বিবেচনায় পানিফলে খাদ্য শক্তি আছে ৬৫ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৮৪.৯ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.৯ গ্রাম, খাদ্য অঁাশ ১.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৫ গ্রাম, চর্বি ০.৯ গ্রাম, শর্করা ১১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১ ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-২ ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৫ মিলিগ্রাম। পানিফলের শুধু খাদ্যগুণই রয়েছে এমন নয়, রয়েছে ঔষধি গুণও। পানিফলের শঁাস শুকিয়ে রুটি বানিয়ে খেলে অ্যালার্জি ও হাত পা ফোলা রোগ কমে যায়।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, পানিফল একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর ফল। অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় সাতক্ষীরা জেলাসহ সাতটি উপজেলার কমবেমী ফলটির চাষাবাদ বেড়েছে। কোনো চাষি কৃষি অফিসে যোগাযোগ করলে তাদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। এছাড়া পানিফল চাষিদের উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সার্বাক্ষণিক সহয়তা করে যাচ্ছে। তবে পানিফল নিয়ে গবেষণা বা সুষ্ঠ পরিকল্পনা করতে পারলে এর পরিধি আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে তার ধারণা।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]