সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার বৈকারি ইউনিয়নে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি কলেজের অধ্যক্ষ মো: জাহিরুল আলমের বিরুদ্ধে অবৈধ সার্টিফিকেটে চাকুরি করা, ৪ কোটি টাকা দূর্নীতি, টেন্ডার ছাড়া ৪৮০টি আমগাছ কাটা সহ নানাবিধ অভিযোগ করেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সদর আসনে মীর মোস্তাক আহমেদ রবি সংসদ সদস্য থাকাকালীন দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ছাত্র ও শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছেন তিনি। গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর থেকে কলেজে অনুপস্থিত রয়েছেন ওই অধ্যক্ষ।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যক্ষ মো: জাহিরুল আলমের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন শিক্ষক ও সাধারন শিক্ষার্থীবৃন্দ। রোববার(১ সেপ্টেম্বর) সকালে এই কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম ‘‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’’ নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগ থেকে ২০০৬ সালে বিএ ও ২০০৭ সালে এমএ পাশের সার্টিফিকেট দেখিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন(ইউজিসি) কর্তৃক সাময়িক অনুমতিপত্র নিলেও তার মেয়াদ ছিলো ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর অবধি। অথচ মেয়াদ উত্তীর্নের পরেও ২০০৭ সালে তিনি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এমএ পাশ করেছেন যা সুস্পষ্ট বেআইনি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তপন কুমার দাসের স্বাক্ষরিত এক পত্রে জানানো হয়, অনুমতিপত্রের মেয়াদ উত্তীর্নের কারনে এবং পরে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করতে না পারায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির প্রদত্ত সনদ, ফলাফল, পরীক্ষা, প্রশাসনিক, একাডেমিক কার্যক্রমের কোন বৈধতা না থাকায় এখান থেকে সনদপ্রাপ্ত কাউকে এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই। ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর এই পত্রটি দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ পাবার সময় জাহিরুল আলম দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জাহির করেন। এর মধ্যে প্রথমটি দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এবং দ্বিতীয়টি খুলনা বিএল কলেজ। একইসাথে দুটি বিশ্বিবিদ্যালয় থেকে একজন ছাত্র কিভাবে পাশ করতে পারে- প্রশ্ন রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া ইউজিসি/বে:বি/৪৮৪(জেপা)/২০১৬(তারিখ ২৯ মার্চ ২০২৩) অনুযায়ী ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’র প্রদত্ত একাডেমিক সনদের আইনগত কোন বৈধতা নেই বলে সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে এক পত্রে জানানো হয় এবং খুলনা বিএল কলেজের সনদটি জাল বলে প্রতীয়মান হয়।
অবৈধ সনদের বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন টিএনও বরাবর অভিযোগ করেছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। টিএনও অধ্যক্ষ জাহিরুল আলমের সনদ তদন্ত করার জন্য যুব উন্নয়নের কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার দাসের কাছে পাঠান। তদন্তে জাহিদুল আলমের সনদ অবৈধ বলে প্রমানিত হয়।
এরপর জাহিরুল আলম বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করলে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মো: হুমায়ুন কবির বিষয়টি তদন্ত করেন এবং তার সনদ অবৈধ বলে ঘোষনা করেন। এছাড়াও খুলনা শিক্ষা অফিসের আঞ্চলিক কার্যালয়েও জাহিরুল আলমের সনদ নিয়ে তদন্ত করতে যান কলেজটির শিক্ষকরা। সেখানে তদন্ত করে সার্টিফিকেট অবৈধ প্রমান হয়। এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবর তদন্তের জন্য আবেদন করা হয়। তদন্তে জাহিদুল আলমের সনদ অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয় এবং তার এমপিওভূক্তি হবে না বলে এক পত্র দিয়ে জানানো হয়। একইসাথে খুলনা বিএল কলেজের সার্টিফিকেটটি জাল বলে প্রমানিত হয়।
কলেজটির যুক্তিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মো: শাজাহান কবির অভিযোগ করে বলেন, ২০০৫ সালে তিনি এই কলেজে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। তিনি কর্মরত থাকা অবস্থায় কয়েকবছর পরে জনপ্রতি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে তার স্থলে আরও দুজনকে নিয়োগ দেন অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম।
অভিযোগ করে প্রভাষক শাজাহান কবির আরও বলেন, এই ঘটনার প্রতিবাদ করায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছেন ওই অধ্যক্ষ।
ক্রীড়া ও শারিরীক শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক মো: আবুল কালাম বলেন, গত দেড় বছর আগে তার কাছ থেকে ১ লাখ টাকা ধার নেন জাহিদুল আলম। সেটি তিনি ৩ মাসের ভেতর পরিশোধ করার কথা দিলেও সময়মতো তা দিতে না পারায় ম্যানেজিং কমিটিকে বিষয়টি জানানো হয়। পরে ম্যানেজিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ২৭ জুলাই তার ওই টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও এখনও তিনি সেই টাকা ফেরত দেননি।
তিনি আরও বলেন, এমপিওভূক্তির মাধ্যমে বেতন ফাইল ছাড়িয়ে দ্রুত তা এনে দেওয়ার কথা বলে ২২ জন শিক্ষকের কাছ থেকে মাথাপিছু ৪৫ হাজার টাকা নিয়েছেন অধ্যক্ষ জাহিরুল আলম। এছাড়া কলেজের ২০ বিঘা সম্পত্তিতে থাকা ৪৮০টি আমগাছ বিনা টেন্ডারে কেটেছেন তিনি। একইসাথে ১৬ বিঘা জমির ঘেরে মাছের হারি দিয়ে তা একাই ভোগ করছেন ওই অধ্যক্ষ। এছাড়া কলেজের জমি থেকে মাঝেমধ্যেই অবৈধভাবে মাটি ও বালি বিক্রি করেছেন তিনি।
কলেজটির অফিস সহায়ক মো: ইলিয়াস হোসেন বলেন, তিনিও ২০০৫ সালে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এরপর কৌশলে তার কাছ থেকে মিষ্টি খাওয়ার কথা বলে ১ লাখ ১১ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন অধ্যক্ষ জাহিদুল আলম। দীর্ঘদিন তিনি বিনা বেতনে কাজ করেছেন। এরপর ২০২২ সালে তার নাম এমপিওভুক্তির জন্য প্রেরন করা হলেও তার স্থলে আনিসুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার অভিযোগ, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আনিসুরকে নিয়োগ করিয়েছে জাহিরুল আলম।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, গত ৫ই আগস্টের পর থেকে অধ্যক্ষ কলেজে না আসায় তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাজে অনেক অসুবিধা হচ্ছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যক্ষ মো: জাহিরুল আলমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে এসব মিথ্যা অভিযোগ ছড়িয়েছে। যে কয়টি গাছ কাটা হয়েছে তা কলেজ থেকে রেজুলেশন করা। তার সব সার্টিফিকেট বৈধ এবং তিনি কারো কাছ থেকে চাকরির প্রলোভনে টাকাপয়সা নেননি। সার্টিফিকেটের বৈধতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় তদন্ত রিপোর্টের কাগজপত্র দেখালে তিনি আর কথা বলতে রাজী হননি।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]