সাতক্ষীরার রাম প্রসাদ ঘোষ: ক্রাচে ভর করা একজন শিক্ষকের আখ্যান
মাত্র দেড় বছর বয়সে ভয়ংকর পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পান। অচল হয়ে যায় একটি পা। খর্ব হয়ে যায় শরীরের গঠন। শৈশব থেকেই শুরু হয় ক্রাচে ভর দিয়ে জীবন যুদ্ধের কঠিন পথচলা। সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে বহু পথ পাড়ি দিয়ে নিজে আলোকিত হয়েছেন। হয়েছেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর।
বলছি দেশের প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার কাজী আলাউদ্দীন ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক রাম প্রসাদ ঘোষের গল্প।
শিক্ষক বাবার কাছেই লেখা পড়ার হাতেখড়ি রাম প্রসাদের। বড় ভাই শংকর প্রসাদের কাঁধে চড়ে প্রথম স্কুলে যাওয়া। স্থানীয় বাথুয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জীবনের প্রথম পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অধিকার করেন। শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। বাবার সাইকেলে চেপে বাবার স্কুল থেকেই ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর কালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক। ক্রাচে ভর দিয়েই এগিয়ে যেতে থাকেন জীবনের লক্ষ্যে। এরইমধ্যে খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও ২০০০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন নিজের সহপাঠীদের পড়িয়েছেন রাম প্রসাদ। ২০০৩ সালে স্থানীয় কাজী আলাউদ্দীন ডিগ্রি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শুরু করেন আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকতা। শিক্ষাদান তাঁর কাছে উপভোগ্য। তিনি এটাকে অবসর কাটানোর মতোই অনন্দের বলে মনে করেন।
অদ্যাবদি তিনি স্থানীয় গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের বিনা টাকায় বা নামমাত্র টাকায় পড়িয়ে চলেছেন। বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল কলেজসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে আছে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। সবার কাছে তিনি প্রিয় রাম প্রসাদ স্যার। প্রিয় বন্ধু।
কাজী আলাউদ্দীন ডিগ্রি কলেজের সাবেক ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (ডুজা) সভাপতি মামুন তুষার। নিজ শিক্ষাগুরুর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, স্যার (রাম প্রসাদ) আলোকিত মানুষ গড়তে ২০০৯ সালে নিজের বাড়িতেই একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্মৃতি অনির্বাণ গ্রন্থালয়ের সংগ্রহশালায় অসংখ্য মূল্যবান বই রয়েছে। বইয়ের একাংশ তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের থেকে উপহার পেয়েছেন, বাকি অংশ সংগ্রহ করেছেন। তিনি প্রায়ই আমাদের বলতেন, একদিন এই লাইব্রেরি অনেক বড় হবে মানুষ আমাকে এই লাইব্রেরির মাধ্যমেই স্মরণ রাখবে।
লেখালেখির সাথেও রাম প্রসাদ ঘোষের রয়েছে সখ্য। তার লেখা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে জল নুপুর, জলঙ্গী (ভারত), সন্ধান, স্বপ্ন রাঙা শশি ও জ্যোৎস্না মোহন পদ্ম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে অভিযাত্রীক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ, রংপুর কতৃক ‘বিশিষ্ট কবি’ সম্মাননায় ভূষিত হন। অতিসম্প্রতি শিক্ষা বিস্তার ও মানবসেবার স্বীকৃতি স্বরুপ কবি সুকান্ত স্মৃতি সংসদ কতৃক ‘মাদার তেরেসা গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড ২০২২’ লাভ করেছেন তিনি।
সুদীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ক্রাচে ভর দিয়ে চলছে কলেজ শিক্ষক রাম প্রসাদ ঘোষের জীবন যুদ্ধ। অনেক মানুষ তাঁর এই জীবন সংগ্রামে সাথী হয়েছেন। তাদেরই একজন তাঁর সহধর্মিণী সম্পা মল্লিক। স্নাতক পড়াকালীন পরিচয় হয় দু’জনের। বর্তমানে মা-বাবাসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিজ গ্রাম সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের আমিয়ানে বসবাস করছেন এই আলোকিত মানুষ।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)