সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি নাজমুল আহসানের গ্রেফতারের দাবীতে মানববন্ধন


আবু সাইদ, সাতক্ষীরাঃ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব ও সাতক্ষীরার সাবেক জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসানের বিরুদ্ধে অবৈধ নির্বাচন, খুন, গুমে অংশ নেওয়াসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে। তার সময়ে যৌথবাহিনীর গুলিতে শুধু সাতক্ষীরাতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন বিএনপি ও জামায়াত শিবিরের নেতাকমীরা। এসব হত্যা কান্ডের বিচার এবং দায়ী নাজমুল আহসানের চাকরিচ্যুতের দাবী জানিয়ে সোমবার সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে।
২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে সাতক্ষীরায় পুলিশের গুলিতে অর্ধশাধীক জামায়াত— শিবির ও বিএনপির নেতাকমীর্ হত্যার নৈপথ্যে ছিলেন তৎকালিন পুলিশ সুপার চৌধুরি মঞ্জুল কবির ও ডিসি নাজমুল আহসান। স্বৈচার শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার আস্থাভাজন পুলিশ সুপার চৌধুরি মঞ্জুল কবির ও বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়। তবে বহাল তরবিয়াতে আছেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অবৈধ নির্বাচন ও খুন গুমে অংশ নেওয়া পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান। তার বিরুদ্ধে দলবাজ কর্মকর্তা হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২৫ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে তিনি সাতক্ষীরার নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। ২৬ জানুয়ারী ২০১৬ পর্যন্ত তিনি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন। সাতক্ষীরা জেলা জামায়াত আমীর সাবেক এমপি অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল খালেকের বাড়ি বুলড্রোজার দিয়ে ভাঙ্গার নির্দেশ তিনি দিয়ে ছিলেন। একই সময়ে সাতক্ষীরাতে যৌথবাহিনীর সাথে ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত অংশগ্রহনের সহযোগী তিনি করে ছিলেন। তার সময়ে সাতক্ষীরাতে সবচেয়ে বেশি হত্যা, খুন, গুম ও গ্রেফতারের শিকার হন বিরোধী দলীয় নেতা কর্মিরা।
নাজমুল আহসান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা। তিনি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) ছিলেন। ১১ ডিসেম্বর ২০২২,তিনি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচে ২৫ এপ্রিল, ১৯৯৪ তারিখে যোগ দেন।
জেলা প্রশাসক হিসেবে নাজমুল আহসানের যোগ দানের ৫দিন পর ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হন আগরদাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপির জনপ্রিয় নেতা মো. আনোয়ারুল ইসলাম (৪৫)। ৩০ ডিসেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে যৌথবাহিনীর ৭—৮ জন সদস্য একটি মাইক্রোবাসে করে সাংবাদিক পরিচয়ে বিএনপি নেতা স্থানীয় চেয়ারম্যান আনোয়ারুলের বাড়িতে গিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া বাড়ি—ঘরের ছবি তুলতে থাকে। সাংবাদিক আসার খবর শুনে আনোয়ারুল ও তার ভাইসহ বেশ কয়েকজন বাইরে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এক পর্যায়ে তারা আনোয়ারুলকে জোর করে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে সাতক্ষীরা সদর থানায় নিয়ে যায়। এরপর ওইদিন দুপুরের দিকে আনোয়ারুলের গুলিবিদ্ধ লাশ শিকড়ির একটি কলাবাগানের মাঠে পড়ে থাকতে দেখে পরিবারকে খবর দেয় স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয়রা জানায়, যৌথবাহিনীর লোকজন ওইদিন থানায় নেয়ার পর আনোয়ারুলকে বেধড়ক মারপিট ও দুই হাত—পা ভেঙে দেয়। দুপুর একটার দিকে সদর উপজেলার শিকড়ি এলাকার একটি ফাঁকা মাঠে নিয়ে তার বুকে, পেটে ও পায়ে পরপর কয়েকটি গুলি করে। এতে আনোয়ারুল ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।
নিহত আনোয়ারুল সদর উপজেলার কাশেমপুর গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। তার বড় ভাই আবদুল গফ্ফার জানান, ওইদিন সকাল ৯টার দিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে কয়েকজন লোক তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে আমরা জানতে পারি আনোয়ারুলের গুলিবিদ্ধ লাশ শিকড়ির একটি কলাবাগানের মাঠে পড়ে আছে। তার দেহ, মাথা, বুকের বাম পাশে ৫টি, পেটে ও পায়ে মোট ৯টি গুলির চিহ্ন ছিল। তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের বক্তব্য সাজানো নাটক ছাড়া কিছু নয়। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল আলিম জানান, আনোয়ারুল একজন জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন। বিএনপির নেতা হিসেবে তিনি আন্দোলন সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকতেন। আর এজন্যই সরকার তাকে টার্গেট করে হত্যা করেছে।
গত ২৪ জানুয়ারি ২০১৪ সন্ধ্যায় যৌথবাহিনীর সদস্যরা দেবহাটা উপজেলার নতুন বাজারের কুলিয়া গ্রামের নিজ বাড়ি থেকে উপজেলা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি আবুল কালাম (১৭) গ্রেফতার করে। একইদিন দুপুরে কুলিয়া এলাকার জামায়াত নেতা কস্ফারী আশরাফুল ইসলামের ছেলে জামায়াত কর্মী মারুফ হাসান ছোটনকে (২২) তার শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর দুজনকে দেবহাটা থানায় নিয়ে যায়। এর দুদিন পর ওই দু’জনের গুলিবিদ্ধ লাশ হাসপাতাল থেকে পুলিশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ, বাড়ি থেকে গ্রেফতারের পর দুদিন থানায় ব্যাপক নির্যাতনের পর ২৬ জানুয়ারি রোববার ভোর সোয়া ৫টার দিকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা কালাম ও মারুফকে সখীপুর ইউনিয়নের নারকেলি গ্রামে এনে বুকে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় ৮—১০ রাউড গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। পরে তাদের দুজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে সখীপুর হাসপাতাল ও পরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহত কালাম সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে অর্থনীতি বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র ও বিবাহিত মারুফ ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে তাদের সংসার চালাতো। বাড়িতে তার স্ত্রী তাসলিমা এবং তামিমা নামে তার আট মাসের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। কালামের পিতা মো. আকবার আলী গাজী জানান, আমার আদরের সন্তানকে ধরে নেয়ার পর দুই রাত ও একদিন একনাগাড়ে তারা নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। দুদিন পর রোববার ভোরে তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। যখন লাশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করে তখন দেখি ওর বুকে, হাতে ও পায়ে গুলির চিহ্ন ছিল। নিহত মারুফ হাসানের ভাই মাকফুর জানান, মারুফকে ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তার শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাকে দেবহাটা থানায় নিয়ে পুলিশ শারীরিক নির্যাতন চালায়। দুদিন থানায় আটক রেখে নির্যাতনের পর আদালতে হাজির না করে অস্ত্র উদ্ধারের সাজানো নাটক সাজিয়ে ২৬ জানুয়ারি রোববার ভোরে দেবহাটার নারকেলি এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে যৌথবাহিনী। তার বিরুদ্ধে কোনো নাশকতার অভিযোগ নেই, থানায় কোনো মামলাও নেই। শুধু জামায়াতের রাজনীতি করার কারণে তাকে হত্যা করা হলো।
২০১৪ সালের ২৭শে এপ্রিল শহরের কামালনগরের ছাত্রশিবিরের মেসে পুলিশ অভিযান চালিয়ে শহর শিবিরের সেক্রেটারী ছাত্রশিবিরের সদস্য আমিনুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে। এসময় আরো ৭জনকে গুলি করা হয়। একইভাবে যৌথবাহিনীর গুলিতে বিএনপি ও জামায়াত—শিবিরের ২৭ জনসহ রাজনৈতিক নেতাকমীর্কে হত্যা করা হয় ডিসি নাজমুল আহসানের সময়ে। এছাড়া ২৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছে আরও কয়েক শতাধিক ব্যক্তি। গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেক নেতাকর্মীদের বাড়ি—ঘর। প্রতিটা হত্যা কান্ডের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে তৎকালিন জেলা প্রশাসক জড়িত বলে ভুক্ত ভোগীরা জানান।
২০ জানুয়ারি ২০১৪ স্বয়ং স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযানের ঘোষণা দেন। সাতক্ষীরা সার্কিট হাউসে এক ঝটিকা সফরে এসে তিনি বলেন, “আমি আপনাদের এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই, সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ থাকবে না। সে জন্য যা যা করণীয় তা করা হবে। যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকবে।”তিনি বলেন,”বিএনপি—জামায়াতের কারণে দেশে যে সহিংসতা, মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন—নিপীড়ন চলছে, তা কোনো অবস্থায় মেনে নেওয়া হবে না। বিএনপি জামায়াত কর্মিরা বাংলাদেশের যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের খুঁজে খুঁজে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন তৎকালিন ডিসি নাজমুল আহসান। তার সময়ে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই রাজনৈতিক সহিংসতায় ৪৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে যৌথবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ২৭ জন। এদের সবাই স্থানীয় বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মী। এছাড়া আরও ২৫ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক ব্যক্তি। তার নের্তৃত্বে যৌথবাহিনীর বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাতক্ষীরার নাগরিকদের মধ্যে এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। রাত শুরু হলেই আতঙ্কে বিভিন্ন স্থানে চলে যেত নারীরাও। প্রতি রাতেই ঘটছে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটত। অগ্নিসংযোগ ও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হতো বিএনপি—জামায়াতের নেতাকর্মীদের বাড়ি—ঘর।

কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)
