শাহরিয়ার আলম রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনের চারবারের সংসদ-সদস্য (এমপি)। এর মধ্যে দুই দফায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারত পালিয়ে যাওয়ার পর তার দোসররাও ভারত পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই এখনও ভারতে অবস্থান করছেন মোদির আশীর্বাদে।
তবে কেউ কেউ ভারত থেকে চলে গেছেন অন্য দেশে। তাদের মধ্যেই একজন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
শাহরিয়ারের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বাঘা-চারঘাটের বাসিন্দারা বলছেন, ৪ আগস্ট বিকালেও শাহরিয়ার তার আড়ানির বাসায় ছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ৫ আগস্ট খুব ভোরে তিনি বাড়ি ছেড়ে সড়কপথে গেদে সীমান্তে পৌঁছান। এরপর তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন।
শাহরিয়ার মূলত ছিলেন ব্যবসায়ী। ২০০৮ সালে প্রথম নির্বাচন করেন তিনি। তখন হলফনামায় ঋণগ্রস্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ১৬ বছরে অভাবনীয় উত্থান ঘটে। রীতিমতো কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক বনে যান শাহরিয়ার ও তার পরিবারের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য-নিশ্চয়ই তিনি রূপকথার গল্পের ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পেয়েছেন।
বাঘার পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের এক নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহরিয়ার। প্রভাব খাটিয়ে লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজাকে ২০২১ সালে মেয়র বানান শাহরিয়ার। লেনিকে লালপুরে কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি করে দেন। ঢাকার গুলশানে লেনিকে ৩ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন। এছাড়া গুলশানে নিজের নামে দুটি এবং ছেলের নামে একটি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি।
দেশ ছাড়িয়ে রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গড়েছেন আটটি পোশাক কারখানা। নিজের রেনেসাঁ গ্রুপের নামে ‘দুরন্ত’ টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ঋণগ্রস্ত শাহরিয়ার ১৬ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক
শাহরিয়ার মূলত ছিলেন ব্যবসায়ী। ২০০৮ সালে প্রথম নির্বাচন করেন তিনি। তখন হলফনামায় ঋণগ্রস্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী ১৬ বছরে অভাবনীয় উত্থান ঘটে। রীতিমতো কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক বনে যান শাহরিয়ার ও তার পরিবারের সদস্যরা। সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য-নিশ্চয়ই তিনি রূপকথার গল্পের ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পেয়েছেন। তা না হলে আলোচ্য সময়ে এমন বিত্তশালী হওয়া কোনোভাবেই একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নামমাত্র মূল্যে রাজশাহীতে ৬০ কোটি টাকার ৪০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল নিয়ে গড়ে তোলেন অ্যাগ্রো ফার্ম। কিনেছেন শতাধিক বিঘা আবাদি জমি। ঢাকাতে রয়েছে কয়েকশ কোটি টাকার আটটি পোশাক কারখানা। রাজশাহী এবং ঢাকায় রয়েছে তার কয়েকটি প্লট এবং ফ্ল্যাট। রাজশাহীতে দুইশ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রাশিয়া, ব্রাজিল এবং চীনেও রয়েছে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। অভিযোগ রয়েছে-দেশের টাকা পাচার করে শাহরিয়ার এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগেও হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এভাবে উল্লিখিত সময়ে হয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগেই অবস্থা বেগতিক দেখে ৪ আগস্ট রাতেই তিনি গা ঢাকা দেন। ইতোমধ্যে শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে তার নির্বাচনি এলাকা বাঘা এবং চারঘাট থানায় আটটি মামলা হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে রোববার সন্ধ্যায় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের মোবাইল ফোন নাম্বারে ডায়াল করা হলে সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর একই নম্বরে তার হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে ‘রিংগিং’ হয়। অর্থাৎ ফোনটি খোলা। পরপর দুবার ডায়াল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর এই প্রতিবেদকের পরিচয় ও কথা বলার বিষয়বস্তু জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা (মেসেজ) দেওয়া হয়।
তবে শাহরিয়ারের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বাঘা-চারঘাটের বাসিন্দারা বলছেন, ৪ আগস্ট বিকালেও শাহরিয়ার তার আড়ানির বাসায় ছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ৫ আগস্ট খুব ভোরে তিনি বাড়ি ছেড়ে সড়কপথে গেদে সীমান্তে পৌঁছান। এরপর তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালের মাঝামাঝি সময় বাঘা-চারঘাটে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হন শাহরিয়ার। কিছু খাদ্যসামগ্রী বিতরণের মাধ্যমে মানুষের কাছে পরিচিতি পান গার্মেন্টস ব্যবসায়ী শাহরিয়ার। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হন। এ সময় হলফনামায় অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার। ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকার। তার নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ২০১৪ সালে চারঘাট সদরের মেরামতপুরে একটি সিনেমা হলের ৩৭ শতক জমি ভবনসহ কোটি টাকা দাম হলেও ক্ষমতার দাপটে মাত্র ৫০ লাখ টাকায় কিনে নেন শাহরিয়ার। ২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভূমি অফিসের পাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৩৩ শতাংশ জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। এছাড়াও বাঘা, লালপুর ও ঈশ্বরদীতে বিভিন্ন নামে-বেনামে শাহরিয়ারের জমি কেনার আরও তথ্য পাওয়া গেছে।
বাঘার পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের এক নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন শাহরিয়ার। প্রভাব খাটিয়ে লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজাকে ২০২১ সালে মেয়র বানান শাহরিয়ার। লেনিকে লালপুরে কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি করে দেন। ঢাকার গুলশানে লেনিকে ৩ হাজার ৬০০ স্কয়ার ফুটের রাজকীয় একটি ফ্ল্যাট উপহার দেন। এছাড়া গুলশানে নিজের নামে দুটি এবং ছেলের নামে একটি ফ্ল্যাট কেনেন তিনি।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনি হলফনামায় শাহরিয়ার নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যমতে, তখন শাহরিয়ারের স্থাবর কোনো সম্পদ ছিল না। এছাড়া ২০২০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বসন্তপুর মোড়ে একই প্লটে ৪০ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার। ওই জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলা সদরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ-জমির মূল্য পরিশোধ না করে শাহরিয়ার আলম প্রতারণার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন সেই জমি।
এছাড়াও লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। মূলত শাহরিয়ার আলমের ছোটবেলা কেটেছে লালমনিরহাট জেলায়। সেই সুবাদেই সেখানে জমি কিনে খামারবাড়ি গড়ে তুলেছেন। তার দীর্ঘদিনের এপিএস সিরাজুল ইসলাম সিরাজের বাড়িও কালীগঞ্জ উপজেলায়। শাহরিয়ার আলমের বাবা মো. শামসুদ্দিন ছিলেন রেলের কর্মচারী। সেই সুবাদে তিনি লালমনিরহাটে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন।
দেশ ছাড়িয়ে রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গড়েছেন আটটি পোশাক কারখানা। নিজের রেনেসাঁ গ্রুপের নামে ‘দুরন্ত’ টেলিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর এসব জমি ও অর্থসম্পদ গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার তার নির্বাচনি এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। তিনি তার এপিএস সিরাজের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগেও করেন বাণিজ্য। চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারও টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ।
তথ্যসূত্র: যুগান্তর
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]