সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে এবং এতে যেভাবে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে এ নিয়ে সচেতন মহলের মধ্যে ক্রমেই মারাত্মক ক্ষোভ এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন এর লাগাম টেনে ধরে রাখা যাচ্ছে না। রাস্তায় বের হলেই সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করে কখন যেন দুর্ঘটনায় কবলিত হই। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বজনরা বাসায় না ফিরে আসে ততক্ষণ পর্যন্ত এই আতঙ্ক চলতে থাকে। এখন প্রশ্ন হল এর থেকে কি পরিত্রাণের কোন পথ নেই? সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে এবং এই কারণগুলো সম্পর্কে আমরা প্রায় সকলেই অবগত আছি। তবে দুর্ঘটনার জন্য মূল ভূমিকা পালন করে চালক নিজে। ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও সেটাও আমি চালককে দায়ী করবো কারন গাড়ী বের করার পূর্বে গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে সব কিছু চেক করার দায়িত্ব চালকের। তাই দুর্ঘটনা রোধ করতে আমি চালক এর প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
এখানে মহাসড়কে অনেক সমস্যা আছে এবং ইচ্ছে করলেই সমস্যাগুলো অচিরেই সমাধান করা সম্ভব নয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক মহাসড়কের সংজ্ঞা অনুসারে কোনোটাকেই আন্তর্জাতিক মানের মহাসড়কে বলা যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে একটা কাজ করতে হবে সেটা হল প্রশিক্ষিত মানবিক ড্রাইভার তৈরি করতে হবে। তার মধ্যে এই উপলব্ধি বোধ জাগ্রত করতে হবে যে তার একটা ভুলের কারণে একটা পরিবারে যেকোনো সময় নেমে আসতে পারে অন্ধকারের হাতছানি। একজন প্রশিক্ষিত ড্রাইভার কখনো হেলপার দিয়ে গাড়ি চালাতে পারে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার পূর্বে ট্রাফিক বিভাগ এবং বিআরটিএ কর্তৃক চালকদের রোড সাইন, রাত্রিকালীন গাড়ির হেডলাইট এর সঠিক ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইনের বেসিক বিষয়গুলো সহ মানবিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরী। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই প্রতিটি চালক যেন রাস্তায় প্রতিযোগীতা নেমেছে। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি মহাসড়কে যত দুর্ঘটনা ঘটে তার শতকরা আশি ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের বেপরোয়া খামখেয়াালিপনা গাড়ি চালানোর ফলে।
মহাসড়কে একই মানের গাড়ি একটা গাড়ি আরেকটাকে ওভারটেক করার প্রয়োজন নেই বললেই চলে অথচ আমরা দেখতে পাই পিছনের গাড়ি সামনের গাড়িটিকে ওভারটেক না করা পর্যন্ত তারা স্বস্তি পায় না। আমাদের দেশের চালকদের এটা একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে ততদিন পর্যন্ত এভাবে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। হাইড্রোলিক হর্ন শব্দদূষণ সহ আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এই ধরনের হর্ন হাইপারটেনশন রোগীর নিকট বাজালে তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রেসার বেড়ে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া ইহা শিশুদের শ্রবণশক্তির মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। তাই এই ধরনের হর্ন বাজানো থেকে চালকদের বিরত থাকতে হবে। এমার্জেন্সি যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি আর একটা গাড়িকে ওভারটেক করার প্রয়োজন হতে পারে।
মহাসড়কে চলার জন্য আমি দুটি রোড সাইন এর কথা বলব। একটা সাইন থাকে সোজা রাস্তায় সাদা ফাঁকা ফাঁকা দাগ এখানে একজন চালক ইচ্ছা করলে ওভারটেক করতে পারে। আর একটা সাইন থাকে রাস্তার বাঁক এলাকায়, ব্রিজের উপর কিংবা বাজার এলাকায়। যতক্ষণ পযন্ত রাস্তার মাঝখান দিয়ে সাদা লম্বা দাগ চলে গিয়েছে সেই জায়গায় ওভারটেক করা সম্পূর্ণ নিষেধ। রাস্তার বাঁক এলাকায় এই চিহ্ন দেওয়া সত্তেও আমাদের চালকেরা এই রোড সাইন না বুঝে ওভারটেক করার চেষ্টা করে ফলে ঘটে যায় মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। আমাদের দেশে অতীতে যে মারাত্মক দুর্ঘটনা গুলো সংঘটিত হয়েছে তার বেশির ভাগ ঘটেছে রাস্তার বাঁকে। ওভারটেক করার নিয়ম হলো ঝামেলামুক্ত জায়গায় সোজা রাস্তায় পিছনের গাড়ি রাইট ইন্ডিকেটর দিলে সামনের গাড়ি যদি লেফট ইন্ডিকেটর দেয় সে ক্ষেত্রে পিছনের গাড়ি সামনের গাড়িটিকে ওভারটেক করতে পারবে। কোন অবস্থাতেই বাম পাশ দিয়ে ওভারটেক করা যাবে না।
প্রাইভেটকার এবং মাইক্রোবাস মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চালানোর ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। এমনও দেখা যায় পুরো পরিবার একসঙ্গে সড়ক দুর্ঘনায় নিহত হচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে মহাসড়ক সুরক্ষিত নয়, তাই আমাদের গাড়ির গতি কমাতে হবে। বাসের জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার এবং ট্রাকের জন্য ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার এবং প্রাইভেট গাড়ির জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। অধিক গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য গাড়ির মালিকেরা অনেকাংশে দায়ী কারণ তারা অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়। মালিকদের কথামতো গাড়ি না চালালে অনেক ক্ষেত্রেই তারা চাকরি হারায়। অনেক সময় মালিকেরা অধিক মুনাফার জন্য ভালো ড্রাইভারদের বাদ দিয়ে নিম্নমানের চালকদের দিয়ে গাড়ি চালায়, ফলে দুর্ঘটনার হার বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে চালকদের চাকরি সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। মাঝে মাঝে যাত্রীরা চালকদের অধিক গতিতে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করে এবং বিভিন্ন ধরনের কমেন্টস করে, এটা আমাদের পরিহার করতে হবে।
বর্তমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানোর ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। মোটরসাইকেলে হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক অথচ অনেকে হেলমেট বিহীন তিনজন মোটর সাইকেল চালানোর ফলে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেক পিতা তার দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে নিয়ে অর্থাৎ মোট চারজন মোটরসাইকেলে ভ্রমণ করে এটা খুবই দুঃখজনক। বাবা হয়ে তিনি পুরো পরিবারকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। ফিডার রোড থেকে প্রধান সড়কে ওঠার নিয়ম হলো প্রথমে প্রধান সড়কের গাড়িকে অগ্রাধিকার দিতে হবে তারপর ডানে বামে দেখে ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে হর্ন বাজিয়ে তারপর প্রধান সড়কে উঠতে হবে। আমাদের দেশের অনেক চালক কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে সাইড রোড থেকে প্রধান সড়কে উঠে যায় ফলে দুর্ঘটনার শিকার হয়। মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সতর্ক থাকতে হবে এক্ষেত্রে ছাত্রদের মোটরসাইকেল এর পরিবর্তে বাইসাইকেল চালনায় উৎসাহিত করতে হবে।
মোট দুর্ঘটনার ৩০% সংঘটিত হয় পথচারীদের সাথে। পথ চলার নিয়মে না জানার কারণে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশের গাড়ি চলে বাম পাশ দিয়ে এবং পথচারী ও হাটে বাম পাশ দিয়ে ফলে পিছন থেকে আঘাতজনিত কারণে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। তারা যদি ডান পাশ দিয়ে হাটতো তাহলে পিছন থেকে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম থাকত কারণ ডানপাশ ব্যবহার করলে পিছনে কোন গাড়ি থাকে না গাড়ি থাকে পথচারীর সম্মুখভাগে। রাস্তা পারাপারের নিয়ম হলো প্রথম ডানে তাকাতে হবে, তারপর বামে, পরিশেষে ডানে তাকিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। কোন অবস্থাতেই অন্যমনস্ক হয়ে কিংবা দৌড়ে বা মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়া যাবে না। পথচলার নিয়মটি প্রাইমারি লেভেলে পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ থাকা জরুরি।
মহাসড়কের এই দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারাদেশে স্পিড গানের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতিজেলায় যদি গাড়িসহ দুটি টিম নিয়োগ করা যায় এবং প্রতিটিতে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকা নির্ধারণ করে দিয়ে স্থান পরিবর্তন করে স্পিড গানের মাধ্যমে দ্রুত গতির গাড়িগুলো শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলার জরিমানা করা অব্যাহত থাকে তাহলে মহাসড়কে চালকরা দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে সাহস পাবে না। দ্রুত গতির গাড়ি সনাক্ত করার জন্য একজন পুলিশ সদস্য স্পিড গান এবং এবং walkie-talkie সহ যে কোন গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দ্রতগতির গাড়িগুলো শনাক্ত করে নির্ধারিত ৫০০ মিটার দূরে অবস্থানরত টিমকে কত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে তা ওয়াকি টকির মাধ্যমে অবহিত করে যদি ঐসব গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং এক্ষেত্রে জরিমানা মালিকের পরিবর্তে চালককে বহন করতে হয় তাহলে পরবর্তীতে চালক দ্রত গতিতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকবে। যদি প্রতিটি টিমে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা যায় এবং দ্রতগতির গাড়ি সহ মহা সড়কে চলাচলরত নসিমন-করিমন, ইজিবাইক, ভটভটি, থ্রি- হুইলার এবং ইঞ্জিন চালিত নিষিদ্ধ গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে নগদ জরিমানা অব্যাহত থাকে তাহলে সারা বাংলাদেশের মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য এবং জাতি এই অভিশপ্ত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে। এই কাজটি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মহাসড়কে একযোগে হতে হবে।
আমার অভিমত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে যে নগদ জরিমানা করা হবে তার শতকরা ৫০ ভাগ টাকা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উক্ত টিমকে ইন্সেন্টিভ হিসেবে দেওয়া হলে এবং অবশিষ্ট ৫০ ভাগ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করলে উক্ত কাজ করতে তারা উৎসাহিত হবে। সকালের দিকে যে দুর্ঘটনাগুলো সংঘটিত হয় তার বেশির ভাগ ঘটে ঘুমের কারণে। একজন চালক আইন অনুসারে একটানা ৫ ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারে অথচ অনেক সময় দেখা যায় যে একজন চালক বিশ্রাম ব্যতীত একটানা ১৩/ ১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছে ফলে ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। যদি মালিক-সমিতি এবং শ্রমিক-ইউনিয়ন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত তাহলে এই দুর্ঘটনাগুলো অনেকাংশে কমানো সম্ভব হতো।
পরিশেষে বলব আমাদের চালকদের প্রতি আরও আমাদের সকলের সদয় হতে হবে এবং মহা সড়কের পাশে তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি চালকদের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করা হয় এবং তাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক:
মো. সালাহউদ্দিন
পুলিশ পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন)
ঝিনাইদহ।
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]