১১বছর বয়সে মিথ্যা মামলায় কারাগারে, ২৬ বছর পর ডিসি’র সহায়তায় মুক্তি
বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ২৬ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান পিয়ারা আক্তার (৩৮)। কারগার থেকে বেরিয়েই হতাশায় পড়েন তিনি। কারণ ছোট থোকতেই তার বাবা মারা যান। এরপর সংসারে আর্থিক অনটন শুরু হয়। নিজের জীবন-জীবিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন অসহায় পিয়ারা। তখন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন উপহার দেওয়া হয়। সেলাই কাজ করে নিজের খরচ চালাচ্ছিলেন পিয়ারা।
এরই মধ্যে পিয়ারার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। স্বজনদের পিড়াপিড়িতে বিয়ের জন্য রাজিও হন পিয়ারা। তবে বিয়ের আয়োজনের খরচ আসবে কোথা থেকে। দরিদ্র ভাইদের পক্ষে সামান্য টাকা খরচ করারও সামর্থ্য ছিল না। এবারও এগিয়ে আসেন জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পিয়ারার বিয়ের জন্য দেওয়া হয় আর্থিক সহায়তা। অবশেষে ৩ মাস আগে অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয় পিয়ারার। নতুনভাবে পথচলা শুরু হয় পিয়ারার।
সেই পিয়ারা আক্তার ভালোবাসা দিবসে স্বামীকে নিয়ে ফুল হাতে সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে হাজির হন বরিশাল জেলা প্রশাসকের সরকারি বাসভবনে। এরপর তারা জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের হাতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানান। জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারও নবদম্পতিকে শুভকমনা জানান। তাদেরকে আপ্যায়ন করেন।
পিয়ারা আক্তার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মৃত আনিস মৃধার মেয়ে। তিন মাস আগে ঝালকাঠীর কাঠালিয়া উপজেলার পশ্চিম পাটিখালঘাটা হাসেম খলিফার ছেলে সেলিম খলিফার সঙ্গে পিয়ারার বিয়ে হয়।
পিয়ারা বেগম জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমিই সবার ছোট। গ্রামে আমাদের কৃষিজমি ছিল। বাবা আনিস মৃধা নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। জমির ফসল বিক্রি করে যা আয় হতো তা দিয়েই বেশ চলতো আমাদের সংসার। অভাব-অনটন ছিল না। আমার পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান। এরপরই চাচা জিয়াউল হক আমাদের জমি দখলের চেষ্টা করেন। জমি দখলের জন্য আমাদের নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন।
‘আমার মা একটুকরা জমিও জীবন থাকতে জিয়াউল হককে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। অন্যদিকে জমির জন্য আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন শুরু হয়।’
পিয়ারা বেগম বলেন, এসব ঘটনা যখন ঘটছিল তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। এভাবে কেটে যায় ৬ বছর। ১৯৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল ১১ বছর বয়সে স্কুল থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। এরপর পানিতে ডুবে চাচাতো বোনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় আমাকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে তখন ১১ বছর থেকে বয়স বাড়িয়ে ১৭ বছর উল্লেখ করা হয়। চাচা জিয়াউল হকের এসব ষড়যন্ত্র বোঝার বয়স ছিল না। পরে মা ও বড় ভাইয়ের কাছ থেকে এসব কথা জেনেছি।
‘আমার স্পষ্ট মনে আছে, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে থাকা এক ব্যক্তি স্কুল থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যান। থানায় নিয়ে আমাকে বলেন, তোমার চাচাতো বোন মেজবিনকে সাঁকো থেকে ফেলে দিয়েছ বলে আদালতে জবানবন্দি দেবে। তাহলে তোমাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসব। অন্যকথা বললে জেলে দেয়া হবে বলেও আমাকে ভয় দেখানো হয়।’
পিয়ারা আক্তার বলেন, ‘আমি ওই পুলিশ সদস্যের শিখিয়ে দেওয়া কথামতো আদালতে জবানবন্দি দেই। আমাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। আমার পরিবারের সদস্যরা তখনও জানতেন না আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সাত মাস পর গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কারাগারে দেখা হয়। এর কয়েক দিন আগে জমি নিয়ে মারামারির একটি মামলায় তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
ওই ব্যক্তি কারাগারে আমাকে জানান, আমাকে গ্রেফতারের কথা পরিবারের সদস্যরা কেউ জানে না। এমনকি গ্রামের লোকজনও নয়। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় আমাকে অনেক খোঁজ করেছে। কয়েক মাস কোথাও সন্ধান না পেয়ে তারা ভেবে নিয়েছে আমার মৃত্যু হয়েছে।
পিয়ারা আক্তার বলেন, ‘গ্রামের ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়ে আমার মা ও ভাইকে বিষয়টি জানান। এরপর একদিন ভাই এসে কারাগারে আমার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আমার ভাই মামলার কাগজপত্র তুলে দেখতে পান, চাচাতো বোন মেজবিন পানিতে ডুবে মারা গেলেও ওই ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমার বয়স ১১ থেকে বাড়িয়ে মামলার এজাহারে ১৭ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই নানাভাবে চেষ্টা করেছেন থানা পুলিশকে বিষয়টি জানাতে। তখন আমার ভাইয়ের বয়সও বেশি ছিল না। তার কথা কেউ শোনেনি। অর্থের অভাবে আমার পক্ষে আইনজীবী দেওয়ার আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি আমার মামলায় কখনো গুরুত্ব দেননি। ১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর এ হত্যা মামলার রায়ে পিরোজপুরের একটি আদালত আমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এরপর পিরোজপুর থেকে বরিশাল কারাগারে আমাকে স্থানান্তর করা হয়।
তিনি বলেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে আসেন জেলা প্রশাসক স্যার। আমার এ ঘটনা তাকে খুলে বলি। তিনি আইনি সহায়তার আশ্বাস দেন। তার প্রচেষ্টায় গত ২০২১ সালের ১০ জুন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আমি মুক্তি পাই। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজের কথা ভেবে দিশেহারা পড়েছিলাম। তখন জেলা প্রশাসক স্যার সেলাই মেশিন দেন। এরপর বিয়ের সম্বন্ধ আসলে নগদ অর্থ দিয়ে সহায়তা করেন। জেলা প্রশাসক স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানাতে স্বামীকে নিয়ে তার বাসভনে গিয়েছিলাম। আমার মতো এক অসহায় নারীর পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বলেই মুক্তি পেয়েছি। তার আর্থিক সহায়তায় বিয়ে হয়েছে। দোয়া করি আল্লাহ স্যারকে ভালো রাখুন।
বরিশাল সমাজসেবা অধিদফতরের প্রবেশন অফিসার সাজ্জাদ পারভেজ জানান, পিয়ারা আক্তার সোমবার সকালে আমাকে ফোন দিয়ে জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে দেখা করা আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি স্যারের অনুমতি নিয়ে তাদেরকে সেখানে নিয়ে গেছি। স্যারের সঙ্গে পিয়ারা আক্তার ও তার স্বামী সেলিম খলিফা শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। ভালোবাসা দিবসে এ ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেও ভালো লাগছে।
জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, পিয়ারা বেগমের ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। তার জীবনের কারাভোগের দীর্ঘ ২৬ বছর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। তবে চেষ্টা করেছি অসহায় পিয়ারা আক্তারের আগামী দিনগুলো যেন সুখে কাটে। পিয়ারা আক্তার তার স্বামীকে নিয়ে দেখা করেছেন। তার মুখে হাসি দেখেছি। আমাকে মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে।
সূত্র: জাগো নিউজ
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)