ফুটবলের মাঠে লড়াকু সৈনিক। রক্ষণাভাগের বাঘা বাঘা বাধা পেরিয়ে বিপক্ষ দলের জালে বল পৌঁছালেও জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে সংসারের অভাব মেটাতে কিনা করতে পারে একটি ছেলে।
বাংলাদেশ পেশাদার লীগে মাঠ কাঁপানো স্ট্রাইকার আরিফের বর্তমান জীবন যেন তারই দৃষ্টান্ত। সর্বোচ্চ লাখ টাকা বছরে পাওয়া দেশের প্রথম শ্রেণির স্বনামধন্য টিমে অংশ নেয়া স্ট্রাইকার আরিফ এখন ৪০০ টাকার যোগালি।
করোনাকালে কোনো টিম তাকে নেয়নি। যা টাকা উপার্জন করেছিল সেই টাকা বাবাকে দিয়েছিল ব্যবসা করতে। কিন্তু লোকসান হওয়ায় পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। বাবা স্ট্রোক করে দুই বার।
কথায় বলে “বিপদ যখন আসে চারদিক থেকে আসে”।
২০১৯ সালে আড়াই লাখ টাকা বাৎসরকি চুক্তিতে চ্যাম্পিয়নস লীগ অগ্রণী ব্যাংক, ২০১৭-১৮ মৌসুম শেখ জামাল টিমে ৬ লাখ, ২০১৬ সাল ৩ লাখ টাকা আরামবাগ কেসি ও ২০১৫ বি লীগ বিজেএমসিতে আড়াই লাখ টাকা চুক্তিতে টিমে সুযোগ পায় আরিফ।
কিন্তু বর্তমানে কোনো টিমে ডাক না পেয়ে তার জীবনে নেমে আসে বেকারত্ব। বাবা মায়ের সংসারের অভাব মেটাতে গত দেড় মাস ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে মাত্র ৪০০ টাকার যোগালির কাজ করছেন স্ট্রাইকার আরিফ হাওলাদার। কিন্তু সেলিব্রেটি খেলোয়াড়ের এ আত্মত্যাগ কি আর গোপন থাকে।
এক কান দু’ কান করে আরিফের যোগালি কর্মের ভিডিও চলে আসে প্রতিবেদকের হাতে।
শুক্রবার বাদ জুম্মা নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার গাবতলীর বাসিন্দা আরিফ হাওলাদারকে শহরের গলাচিপা চেয়ারম্যান বাড়ির নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে যোগালির কাজ করা অবস্থায় পাওয়া যায়। ওই সময় নিজের জীবনে দুর্দশার কথা জানিয়ে লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আরিফ।
তাৎক্ষণিক আরিফকে যোগালির কাজ থেকে ফিরিয়ে আনেন এই প্রতিবেদক।
শুক্রবার বাদ জুম্মা আরিফ হাওলাদার বলেন, করোনাকালে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। ৬ লাখ টাকা বাৎসরিক চুক্তি ছিল শেখ জামাল টিমে। যা টাকা উপার্জন করেছিলাম বাবাকে দিয়েছিলাম ব্যবসা করতে। বাবা পরিবহন ব্যবসা করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে প্রায় সব টাকা খুইয়ে ফেলেন। এরমধ্যে এই কারোনাকালে আমাকে কোনো টিম চুক্তিতে নেয়নি। ২০১৯ সালে ঢাকা চ্যাম্পিয়নস লীগে অগ্রণী ব্যাংকে বাৎসরিক ৩ লাখ টাকা চুক্তিতে খেলেছি।
কিন্তু ২০২০ সালের লীগে কোনো টিম না ডাকলে বেকার হয়ে যায় আমি। টিম না পাওয়ার কারণে আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আমার বাবা দুই বার স্ট্রোক করেছেন। বাসা ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালা খারাপ ব্যবহার ও অন্যদিকে ঘরে অভাব। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেই কারো কাছে হাত পাতব না। নেমে পড়ি যোগালি কাজে। গত দেড় মাস যাবত কাজ করে যাচ্ছি। বাসার কেউ জানত না আমি যোগালির কাজ করছি। কোনো সময় এই কাজ করিনি বলে পা কেটে গেছে। কিন্তু আর গোপন রাখতে পারলাম না। তবে অনেককে নানা কৌশলে নিজের সমস্যার কথা জানিয়েছিলাম। হয়ত কেউ উপলব্দি করতে পারেনি। আর লজ্জায় ভেবেছি কারো কাছে হাত পাতার চেয়ে খেটে খাওয়া ভালো। মাত্র ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি।
বিকালে আরিফের গাবতলী খানকা শরীফ বাড়িতে গেলে আরিফের যোগালি জীবনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আরিফের মা মফিজা বেগম।
তিনি বলেন, সংসারে অভাব মেটাতে আমার ছেলেটা যোগালির কাজ করছে। এটা আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওর পায়ে কাটা ছেড়া ও শরীর ব্যথার কথা শুনে সন্দেহ হয়। পরে এলাকার অনেক মানুষ জানায় আমার ছেলে আমাদের সংসারের অভাব মেটাতে যোগালির কাজ করছে। এই বলেই আরিফের মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
আরিফ আরো জানায়, আমি বেঁচে থাকতে আমার বাবা মা না খেয়ে থাকবে তা হতে পারে না। আমি খেটে খেতে চাই। আমি আমার যোগ্যতা প্রমাণ করে ফুটবলে ফিরতে চাই।
আরিফের বাবা শাজাহাজন হাওলাদর জানান, জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৩, ১৪ ১৬ কিশোর থেকেই ফুটবলে সুযোগ পেয়েছিল। ওর যা পুঁজি ছিল আমি ব্যবসা করতে গিয়ে খুইয়ে ফেলেছি। আমি গর্বিত আমার সন্তান নিয়ে। সংসারের অভাব মেটাতে যোগালির কাজ করলেও সে কারো কাছে হাত পাতেনি। সে কর্ম করে সংসারের অভাব মেটানোর চেষ্টা করছে।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন
প্রকাশক : আরিফ মাহমুদ, প্রধান সম্পাদক : কাজী আবু ইমরান, সম্পাদক : আবু রায়হান মিকাঈল
ফেসবুক পেইজঃ facebook.com/kalaroanewsofficial, ই-মেইল : [email protected]