জলবায়ুর পরির্বতন : টিকে থাকার লড়াইয়ে বাংলাদেশ


বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে বহুদিন ধরেই আলোচিত। সর্বশেষ প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গবেষণা প্রতিবেদনগুলো আবারও প্রমাণ করেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার ধাক্কায় দেশের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঘন ঘন বন্যা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়—সবকিছু মিলিয়ে জনজীবন থেকে শুরু করে অর্থনীতি, কৃষি ও শ্রমবাজার পর্যন্ত ভয়াবহ সংকটে পড়তে চলেছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা প্রতি দশকে প্রায় ০.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়েছে। ২১শ শতকের শেষে এই বৃদ্ধি পৌঁছতে পারে ২.৫ ডিগ্রির বেশি। এর ফলে গ্রীষ্ম মৌসুমের তাপদাহ অস্বাভাবিক রূপ নিচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে নগর শ্রমজীবী মানুষের ওপর। ঢাকায় চলতি বছরে তাপসূচক (হিট ইনডেক্স) একাধিকবার ৪৮ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা প্রাণঘাতী ঝুঁকি তৈরি করেছে। শ্রমিকরা অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হচ্ছেন এবং মৃত্যুও ঘটছে।
শুধু শহর নয়, গ্রামীণ অঞ্চলেও জলবায়ুর ধাক্কা তীব্র। সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭ শতাংশ জমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এতে দেশের অন্তত ৩০ শতাংশ আবাদি জমি নষ্ট হয়ে কৃষি উৎপাদন ভয়াবহভাবে হ্রাস পাবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের বসতভিটা হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ইতিমধ্যে ২০২৪ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
চরম বৃষ্টিপাতও জলবায়ু পরিবর্তনের এক বড় হুমকি। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে আগামী দশকগুলোতে দৈনিক বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে দ্বিগুণেরও বেশি। শতাব্দীর শেষে তা প্রায় ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এর মানে, ভবিষ্যতে হঠাৎ বন্যা ও ভূমিধসের মতো বিপর্যয় আরও ঘন ঘন ঘটবে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রাও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বিশেষ করে মেঘনা মোহনা ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলে শতবর্ষীয় ঝড়ের জলোচ্ছ্বাস ৩.৫ মিটার থেকে বেড়ে ৫ মিটারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই বহুমুখী প্রভাব সরাসরি আঘাত হানছে শ্রমবাজারে। পোশাকশিল্প খাতের ওপর করা এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৩৬ শতাংশ শ্রমিক তীব্র তাপজনিত চাপের কারণে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। উৎপাদনশীলতা ইতোমধ্যেই কমে এসেছে, অনুপস্থিতি বেড়েছে এবং নারী শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কৃষি খাতেও পরিস্থিতি একই রকম; ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, নতুন কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দেখা দিচ্ছে, আর লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চলে ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
তবে এ অন্ধকার চিত্রের মাঝেও আশার আলো দেখা যায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহায়তায় নানা অভিযোজন কর্মসূচি চালু হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণ সহনশীল ধান ও সবজি চাষের উদ্যোগ বাড়ছে, স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ প্রস্তুতির কার্যক্রম জোরদার হচ্ছে এবং পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারও বাড়ছে। ইউনেসকোর “ক্লাইমেট স্মার্ট এডুকেশন সিস্টেম” উদ্যোগ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে চালু হয়েছে, যা তরুণ প্রজন্মকে জলবায়ু সচেতনতা ও অভিযোজন দক্ষতায় প্রশিক্ষিত করার চেষ্টা করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ও প্রভাব এত দ্রুত যে, জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকে আরও কার্যকর, সমন্বিত এবং দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও প্রয়োজন বাড়তি সহায়তা, বিশেষ করে অভিযোজন তহবিল ও প্রযুক্তি স্থানান্তরে। না হলে আগামী কয়েক দশকে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশ নয়, বরং অর্থনীতি, শ্রমবাজার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে গেছে। তাই এই সংকট মোকাবিলায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া টিকে থাকার লড়াই সম্ভব নয়।

জুবায়ের ইসলাম
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)

একই রকম সংবাদ সমূহ

সাতক্ষীরায় ১১ বছরের শিশুকে পানিতে ডুবিয়ে হ*ত্যার অভিযোগ
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: সাতক্ষীরা পারিবারিক বিরোধের জেরে মোরসালিন নামের ১১ বছরের এক শিশুকেবিস্তারিত পড়ুন

দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে দেয়া হবে বিশেষ প্রশিক্ষণ
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরাপদ করতে দেড়বিস্তারিত পড়ুন

অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিকবান্ধব না হলে আর কে হবে: উপ-প্রেস সচিব
বিগত সরকারের আমলে শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হওয়া প্রায় সব মামলাবিস্তারিত পড়ুন