ঠাকুরগাঁওয়ের আরেফা হোসেন ৬২ বছর বয়সে স্নাতকোত্তরে প্রথম
জ্ঞানার্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, ধৈর্য ও চেষ্টা থাকলে বয়স যে বড় বাধা নয়, তার দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণ দিয়েছেন ঠাকুরগাঁওয়ের আরেফা হোসেন। ৬২ বছর বয়সী ওই নারী জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। চলতি বছরের ১৭ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিপ্রোডাক্টিভ অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ নিয়ে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তিনি ফলাফলেও প্রথম হয়েছেন।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে আরেফা হোসেনের জন্ম। মাত্র চার বছর বয়সে মাকে হারান তিনি। এরপর বয়স যখন আট তখন হারান বাবাকে। পাঁচ বোনের মধ্যে আরেফা ছিলেন তৃতীয়। তাঁদের একমাত্র অভিভাবক ছিলেন বড় বোন। কিন্তু অল্প বয়সে বড় বোনেরও বিয়ে হয়ে যায়। এ সময় তিনিসহ তাঁর তিন বোন খ্রিষ্টান মিশনারি চ্যারিটেবলে আশ্রয় নেন।
সেখানে ভর্তি হন মিশনারি স্কুলে। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করার সময় একটি সিনেমায় তিনি দেখেন, অনাথ এক মেয়ে স্বেচ্ছায় মানুষকে সেবা দিচ্ছে। সেই থেকে স্বপ্ন বুনতেন তিনিও একদিন নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহীর ক্রিশ্চিয়ান মিশন হাসপাতালে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৮১ সালে পড়ালেখা শেষ করেন তিনি। পরে ১৯৮২ সালের ৬ জুন ঠাকুরগাঁও মহকুমা হাসপাতালে (বর্তমানে আধুনিক সদর হাসপাতালে) জুনিয়র নার্স হিসেবে যোগদান করেন।
চাকরির দুই বছর হতে না হতেই আওয়ামী লীগ নেতা হামিম হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আরেফা হোসেন। বছর না যেতেই কোলজুড়ে আসে সন্তান। এতে বেড়ে গেল তাঁর আরও দায়িত্ব, কমে গেল সময়। একদিকে সংসারের ব্যস্ততা, অন্যদিকে কর্মময় জীবন। এগুলো বাদ দিয়ে আলাদা কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ হওয়ার সুযোগ ছিল না তাঁর। তবে মনে তাঁর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুপ্ত বাসনা তাড়া করত। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে আবার শুরু করেন পড়াশোনা। বিএসসি করার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মহাখালী সেবা মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে দমেননি তিনি। বরং চাহিদা বেড়েছে স্নাতকোত্তর করার।
বর্তমানে আরেফা হোসেন ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে ৩৮ বছরের চাকরিজীবন শেষে ঠাকুরগাঁও নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজে অধ্যক্ষ পদে রয়েছেন। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে পরিবার ও কর্মস্থলের ব্যস্ত সময়। এ বয়সে পড়াশোনা যেন আকাশকুসুম বিষয়। তবু সব বাধা ডিঙিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেন তিনি। উচ্চশিক্ষার সনদ পেয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন আরেফা হোসেন।
এ বিষয়ে আরেফা হোসেন বলেন, আমার জন্ম নাটোর জেলায়। সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমরা পাঁচ বোন ছিলাম। ছোটবেলায় মা-বাবা মারা যান। বড় বোন আমাদের দেখাশোনা করতেন। কিছুদিন পরে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমাদের দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। আমিসহ আমরা তিন বোন সেখানকার একটি আশ্রমে বড় হয়েছি। তবে এখন আমরা সবাই মাথা উঁচু করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি।’
আরেফা হোসেন আরও বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার। কিন্তু চাকরির পরে বিয়ে, তারপর সন্তান হয়ে যায়। মনে হয়েছিল হয়তো আর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব না। তবে আমার স্বামী আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, সে এখন নেই। ২০১৯ সালে মারা গেছে। আমার বড় ছেলে আসিক হোসেন ঢাকার নিউজবাংলা ২৪-এর সাব এডিটর হিসেবে কাজ করছে। ছোট ছেলে আদিব হোসেন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। আমার সাফল্যে সন্তানেরা খুব খুশি।
অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং কোর্স সমন্বয়কারী আরিফুজ্জামান খান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ৬২ বছর বয়সী আরেফা হোসেন স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩ দশমিক ৬৫ পেয়ে প্রথম হয়েছেন।
এ নিয়ে ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের সভাপতি মনসুর আলী বলেন, আরেফা নারী জাগরণে অগ্রদূত। এটি নতুন প্রজন্মের জন্য একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।
আরেফা হোসেনের এই সাফল্যের বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান বলেন, ‘জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও আরেফা হোসেন শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ ছাড়েননি। কঠোর অধ্যবসায় করে ভালো ফল করেছেন। এটি যেমন অনুকরণীয়, তেমনি অনুপ্রেরণারও বিষয়। আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করছি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)