নড়াইলের ইতিহাস ‘পাতালভেদী রাজার বাড়ি’
নড়াইল সদরের নয়াবাড়ি গ্রামে নবগঙ্গা নদীর তীরে এই ঢিবিতে ছিল পাতালভেদী রাজার বাড়ি নড়াইলের নবগঙ্গার তীরে সিঙ্গিয়ার নিকটে নয়াবাড়ি গ্রামে এক পাতালভেদী রাজার দুর্গবাড়ির ভগ্নাবশেষ ছিল। তার প্রকৃত পরিচয় জানা যায় না। তবে তিনি পাতালভেদী রাজা নামেই পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ বলেন সিঙ্গাশোলপুর প্রভৃতি স্থানে যে রায় উপাধিধারী শৌলোক (সৌলুক) গণের বাস আছে, পাতালভেদী রাজা সেই বংশীয়। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা সেখানে খননকাজ চালিয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, নড়াইল জেলার হবখালী ইউনিয়নের নয়াবাড়ি গ্রামে এক অখ্যাত রাজার রাজবাড়ির ধংসাবশেষ বিদ্যমান। অখ্যাত রাজার নাম জানা যায়নি। স্থানীয়ভাবে ‘পাতালভেদী রাজার রাজবাড়ি’ নামে জনশ্রুতি রয়েছে। সম্ভবত এ পাতালভেদী রাজার রাজবাড়ি এবং এ রাজবাড়ির সুড়ঙ্গপথ, পরিখা এবং দুর্গই হলো নড়াইল জেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপনার আদি নিদর্শন। ইতিহাস সমর্থিত সূত্রে তদানীন্তন সমতট জনপদের অন্তর্গত বর্তমান নড়াইল জেলার শেখহাটি ও নয়াবাড়িতে অন্তত দুটো ক্ষুদ্র আঞ্চলিক রাজ্যের কথা জানা যায়।
নয়াবাড়ির কথিত পাতালভেদী রাজা এবং উজিরপুর কশিয়াড়ার রাজা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রত্নস্থলটি নড়াইল সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে। নড়াইল-মাগুরা পাকা সড়ক সংলগ্ন পশ্চিম পাশে অবস্থিত প্রত্নটিবির প্রায় ৩০০ মিটার উত্তর-পূর্ব পাশে নবগঙ্গা নদী প্রবাহিত। সতীশ চন্দ্র মিত্র প্রণীত ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থ হতে জানা যায়, ‘মাৎস্যন্যায়’ আমলে নড়াইল জেলার শেখহাটি ও নয়াবাড়িতে অন্তত দুটো ক্ষুদ্র রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।
শশাঙ্কের পরবর্তীকালে প্রায় দেড়শ’ বছর কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সুযোগে প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ক্ষুদ্র আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এ পর্বকে মাৎস্যন্যায় (৬০০-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
২০১৪-১৫ অর্থ বছরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নড়াইল জেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনাকালে এই ঢিবিটি শনাক্ত করে লিপিবদ্ধ করা হয়। স্থানীয় কর্তৃক পাতালভেদী রাজার রাজবাড়ি অনেক আগেই প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। ধ্বংসাবশেষের ১টি ঢিবি, রাজবাড়ির ১টি বেষ্টনী গড় ও ২টি পুকুর কালের সাক্ষী হিসেবে এখনো টিকে আছে। প্রাপ্ত ঢিবিটির আয়তন ৮১০ বর্গ মিটার। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১.৫১ মিটার উঁচু।
জরিপকালে পর্যবেক্ষণে এ রাজবাড়ির স্থাপনায় ব্যবহৃত পাতলা ইট ও চুন-সুরকি দেখা যায়, এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এক সময় এ ঢিবিতে প্রাচীন স্থাপনা ছিল। বর্তমানে কথিত পাতালভেদী রাজার রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের মধ্যে কতিপয় স্থানীয় লোকজন বসতি স্থাপন করে ফসলের চাষাবাদ করছে। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে ঢিবিতে হাল-চাষের সময় প্রাপ্ত ইট বসতঘরগুলোতে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ কথিত রাজবাড়ির বেষ্টনী গড় ও পুকুরগুলো অগভীর জলাশয়ে রূপ নিয়ে কোনোমতে অস্তিত্ব ধরে রেখেছে।
এই প্রত্নটিবিটি ২০২২ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। নড়াইল জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস থেকেও এই ঢিবিটি সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত পাতালভেদী রাজারবাড়ি ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান, প্রাচীন ভূমিরূপ, স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ নমুনা থেকে প্রতীয়মান হয় এর মাটির নিচে সম্ভবত আদি ঐতিহাসিক যুগের কোনো গুররুত্বপূর্ণ নিদর্শন বিলুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই প্রত্নস্থল থেকে অনতিদূরেই প্রাচীন বাংলার আদি ঐতিহাসিক যুগের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ভাতভিটা (মাগুরার সীমাখালী) প্রত্নস্থলের অবস্থান।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ধারণা, প্রায় ১৯.৬৯ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত মধ্যম আকৃতির উচ্চতাবিশিষ্ট টিবিটি খনন করে উম্মোচিত করা গেলে এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে নড়াইল জেলার প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। প্রত্নটিবিতে পরীক্ষামূলক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে : উৎখননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপর ভিত্তি করে নড়াইল তথা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ইতিহাস পর্যালোচনা করা, বিস্মৃত জনগোষ্ঠির ইতিহাস উন্মোচন করা, অত্র অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পুনর্গঠন করা। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, এটা খনন করা হয়েছে। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে মাধ্যমে এই অঞ্চলের অনেক ইতিহাস জানা যাবে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)