বর্তমান প্রজন্মকে পরিবেশ সুরক্ষায় ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে
তারিক ইসলাম: আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে আমাদের পরিবেশ। পরিবেশের প্রধান তিনটি উপাদান হচ্ছে মাটি, পানি ও বায়ু। এসব উপাদান ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারি না।
যেগুলো দূষিত হলেই দূষিত হয় পুরো পৃথিবী। এসব উপাদান বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের মতো আমাদের দেশেও দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই পরিবেশ দূষণের কারণেই বিশ্বে প্রতিবছর মৃত্যু হয় এক কোটিরও বেশি মানুষের। আর শুধু বাংলাদেশের কথা যদি বলি, প্রতিবছর মৃত্যু হয় দুই লাখেরও বেশি মানুষ।
পৃথিবীকে দীর্ঘজীবী করা এবং প্রাণিকুলের বাঁচার উপযোগী রাখতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক। বর্তমানে পরিবেশ ধ্বংসকারী নানা প্রতিকূলতার কারণে জীববৈচিত্র্য বিনষ্টের পথে। যেমন সুন্দরবনের গাছপালা কাটার কারণে হিংস্র পশুরা লোকালয়ে আসছে ও পাহাড় কাটার কারণে ঘনঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। কারণ, পরিবেশের একটি উপাদান আরেকটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
পানির সঙ্গে যেমন গাছপালার সম্পর্ক, তেমনি গাছপালার সঙ্গে প্রাণিকুলের সম্পর্ক। পরিবেশের একটি উপাদান বাদ দিলে আরেকটি অচল হয়ে পড়ে। তাই আল্লাহ তাআলা পরিবেশ রক্ষার জন্য মানুষকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। কারণ, পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানুষ ও প্রাণিকুল বাঁচে।
আমরা যদি একটা পৃথিবী কল্পনা করি যা বৃক্ষহীন, জলাভূমিহীন এবং বৃষ্টিশূন্য, প্রথমেই যা মাথায় আসবে তা হলো ধূসর, জীবনবিহীন একটি গ্রহ, যেখানে প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই। আদিম মানুষ প্রকৃতির সাথে সমন্বয় রেখে বসবাস করতো।
কিন্তু সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানুষ নিজের হাতে এই সমন্বয় নষ্ট করে নতুন সব প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটিয়েছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এখন ৪১৫ পিপিএম যা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে দিন দিন এই পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করতে গিয়ে আমরা আসলে কতখানি পিছিয়ে যাচ্ছি তা বোঝা যায়, যখন দেখি বর্তমানে দেশে জনপ্রতি বনভূমির পরিমাণ প্রায় ০.০২ হেক্টর মাত্র। আমরা যদি অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশে প্রকৃতিকে না রেখে উন্নয়নের মিছিলে অংশগ্রহণ করি তবে সেই উন্নয়ন মানব সভ্যতার জন্য কতটা যৌক্তিক হবে সেটা বিবেচনার বিষয়। প্রায়শই দেখি রাস্তায় গাছ কেটে, জলাশয় ভরাট করে, খেলার মাঠ দখল করে উন্নয়নের কাজ চলছে। যেখানে তৈরী করা হচ্ছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত বহুতলভবন, আবাসিক হোটেল, সোসাইটি এবং সুপারমার্কেট।
বংলাদেশে গাছ কেটে, খাল- বিল – নদী ভরাট করে, ভূমির উপরি ভাগের মাটি পুড়িয়ে ইট বানিয়ে, শিল্প ও মানব বর্জ্য সরাসরি পরিবেশে উন্মুক্ত করে, নদীতে ফেলে, জলাভূমিতে আবাসন ও নগরায়ণ করে দেশজ প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি বাড়ানো হয়। পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে বাংলাদেশের উন্নয়নের এই মডেলকে একেবারেই ভঙ্গুর বলা যায়।এটাকে পরিবেশের ওপর চালানো একধরনের ” উন্নয়ন সন্ত্রাস ” বলা চলে। নাগরিক এবং সরকার উভয়েরই পরিবেশগত দায়বদ্ধতা শুধু শূন্য নয়,বরং বহু ক্ষেত্রে বেশ ঋণাত্নক।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি লাইন এখানে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক–
‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর’
সেই অরণ্যকে আমরা কি আর ফিরিয়ে আনতে পারবো তার সেই চিরচেনা রূপে? মানবসভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রকৃতির যথোপযুক্ত সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে।’ এই বিষয়টি কি শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব, নাকি আমাদেরও এ বিষয়ে করণীয় আছে?
সম্প্রতি,সাতক্ষীরার নদী উপকূলে সামাজিক বনায়নের তিন তিন শতাধিক গাছ কেটে নিধনের প্রতিবাদে শ্যামনগর বাসস্ট্যান্ডে পরিবেশকর্মী ও এলাকাবাসীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবাদী মানববন্ধন ও সমাবেশ।মানববন্ধন ও সমাবেশ শেষে ইউএনও বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন পরিবেশবাদী ও আন্দোলনকারী এলাকাবাসী।যার উল্লেখ যোগ্য নেতৃত্বে ছিল তরুণ প্রজন্মের একটা উল্লেখ যোগ্য অংশ।
পরিবেশ সংরক্ষনে তারুণ্যের এ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে মনে পড়ে যায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি পংক্তি –
“কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ,
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!”
প্রযুক্তি এসে যেমন আমাদের জীবন যাপনকে সহজ করেছে, তেমনই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে পরিবেশের ওপরে। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার ওপরেই বর্তায়। একটু চেষ্টা করলেই পরিবেশ রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারি আমরাও।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও বিশ্বজুড়ে প্রতিবেশ বিনষ্ট এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের বিলুপ্তির মূলে রয়েছে মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড। জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের সংকল্প বাস্তবায়নে মানুষের ভূমিকা রাখতে হবে। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে। জলাভূমি ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়নের নামে শুধু কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এখনো সময় আছে, পরিবেশ ধ্বংস না করে সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
পরিবেশ সংরক্ষণ সমন্বিত কর্ম কৌশল ও সবুজ টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আমাদের সচেতনতামূলক প্রচারণা বাড়িয়ে দূষণ কিছুটা হলেও কমাতে হবে।
শুধু আইন করলেই হবে না, পরিবেশ সুরক্ষায় নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। দেশের প্রতিটি মানুষকে জানাতে হবে, কী হচ্ছে? আর এর ফলে নিজেরা কীভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি। এজন্য দেশের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। আসুন আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য সচেতনতা ও পদক্ষেপকে উৎসাহিত করি। সবাই মিলে চেষ্টা করলে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখা সম্ভব।
পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য বেশি নয়, আমরা যদি শুধু দুটি অভ্যাস গড়ে তুলি, তাহলে পরিবেশ দূষণ থেকে আমরা সহজেই রক্ষা পাব। তাহলে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা–আবর্জনা ফেলা। গাছ না কাটা এবং বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে।
তৃতীয় কাজ সরকারের, তা হলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা ময়লা–আবর্জনাগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে। দুটি আমাদের আর একটি সরকারের—এই তিনটি কাজ যদি আমরা সঠিকভাবে করতে পারি, তাহলে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য কোনো আইনের প্রয়োজন হবে না। পরিবেশ রক্ষায় হাজারকোটি টাকা ব্যয় করতে হবে না। সুতরাং, পরিবেশ রক্ষাই আমাদের দায়িত্বশীল হতে হবে।বর্তমান প্রজন্মকে পরিবেশ সুরক্ষায় ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)