কয়েক গ্রামের ছেলেমেয়েদের
‘ভালো বিয়ে’ হচ্ছে না একটি সেতুর অভাবে!
সেতুর কারণে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতে যাতায়াতের সমস্যার কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু এমন কথা হয়তো শোনা দুষ্কর- সেতুর কারণে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ভালো সম্বন্ধ (বিয়ে) হয় না।
এমন ঘটনাও ঘটছে হবিগঞ্জে।
শুধুমাত্র একটি সেতুর জন্য দুর্ভোগের শিকার কয়েকটি গ্রামে ভালো পরিবার বা ভালো জায়গায় আত্মীয়তা করা হয়না তাদের। অনেককেই বিয়ে-সাদি দেয়া বা করানোর জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে অন্যত্র যেতে হয়।
এমন আক্ষেপ রয়েছে জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের। তবে সেতুটি নির্মাণে বারবারই চেষ্টা করেছেন বলে জানালেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।
কালিয়ারভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক চৌধুরী জানান, তারা বারবারই রেজুলেশন করে সরকারের কাছে ব্রিজটির জন্য লিখেছেন। একবার এটি মঞ্জুরও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে কেন যেন আটকে গেল তা তার জানা নেই।
তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আসলে ব্রিজটি করার কোন সুযোগ নেই। সরকার যদি সহায়তা না করে তবে তা সম্ভব নয়। আমরা বারবারই চেষ্টা করছি।
লহরজপুর গ্রামের নুরুল আমিন বলেন, আসলে যাতায়াতের কারণে আমরা যেমন লেখাপড়া করতে পারিনি, এখন আমাদের প্রজন্মও লেখাপড়াসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ছে। পাশাপাশি একজন অসুস্থ হলে রোগী নিয়েও যাওয়া সম্ভব হয়না। বাঁশের সাকু দিয়ে পারাপার বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
সাকিরা বেগম চৌধুরী বলেন, ব্রিজের কারণে আমাদের সন্তানরা পড়ালেখা করতে পারেনা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় যেতে পারেনা। একজন অসুস্থ হলে রোগী নিয়েও যাতায়াত করতে পারিনা।
প্রবীন মুরুব্বী মো. এখলাছ মিয়া চৌধুরী জানান, স্বাধীনতার পর থেকে তাদের এ গ্রামে কোন উন্নয়ন হয়নি। একটু বৃষ্টি হলেই সাকু দিয়ে নদী পারাপার হতে পারিনা। বয়স্ক বা শিশু হলেতো আর কথাই নেই। অনেকেই নদীতেও পড়ে যান।
তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো এ ব্রীজটির কারণে ভালো কোন জায়গার মানুষ এ গ্রামে আত্মীয়তা করতে চায় না। শুধু বংশ দিয়ে হয়না। এ যুগে এসেও বাড়িতে একটি গাড়ি যায় না তা কি হতে পারে। ভালো সম্বন্ধের আলাপ এলেও তা আর টেকে না।
মো. আব্দুল জাহির আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ভালো জায়গায় একটি আত্মীয়তা করতে পারিনা। বিয়ে দিতেও পারি না, করাতেও পারিনা। ভালো মানুষ কেউ এ গ্রামে আত্মীয়তা করতে চায়না। ভালো জায়গায় সম্বন্ধ করতে হলে অন্যত্র বাড়ি ভাড়া নিয়ে যেতে হয়।
তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে অন্তত ৫০ বছর ধরেই আমি বাঁশের সাকু আর নৌকায় শাখা বরাখ নদী পারাপার হচ্ছি। তিনি দ্রুত ব্রিজটি নির্মাণের দাবি জানান।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর একটি শাখা ‘শাখা বরাখ’ নদী। এটি বাহুবল, হবিগঞ্জ সদর, নবীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলার হাওর দিয়ে বয়ে গেছে। এ নদীটি যেমন হাওরবাসীর সুখের সাথি তেমনি এ নদীর কারণে দুঃখেরও অন্তঃ নেই।
এ নদীর বেশীর ভাগ অংশই পড়েছে নবীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলায়। যদিও বানিয়াচংবাসীর যাতায়াতে এ নদীর তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। কিন্তু নবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামকে নানাভাবে ঘিরে রেখেছে এ নদী। তেমনি ওই উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা ইউনিয়নবাসীরও সুখ-দুঃখেরও সাথি হয়ে আছে এ নদীটি।
নদীর পূর্বপাড় দিয়ে মাত্র কোয়ার্টার কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ সড়ক। জেলা সদর থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। আর পশ্চিমে রয়েছে লহরজপুর, খলিলপুর, সৈয়দাবাদসহ অন্তত ১০টি গ্রাম। গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের শাখা বরাখ নদী পেরিয়েই জেলা ও উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়।
শিক্ষার্থীদেরকেও প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজে যেতে হয়। তাই যাতায়াতের জন্য এ এলাকার বাসিন্দারা নদীর উপর বাঁশ-কাঠ দিয়ে নির্মাণ করেছেন একটি সাঁকো। সাঁকুর দৈর্ঘ্য ছোট করতে ইতিমধ্যে নদীর অর্ধেক অংশ ভরাটও করেছেন তারা। রোগী নিয়েও এ সাঁকু দিয়েই পারাপার হতে হয়। এতে অনেক সময়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেকেই পা ফঁসকে নদীতে পরেন। এছাড়া তাদেরকে হাওরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শ্রীমতপুর গ্রামে নির্মিত পাকা সেতু দিয়ে পারাপার হতে হয়।
এদিকে গ্রামের পাশেই রয়েছে জেলার বৃহৎ হাওর ঘুঙ্গিয়াজুরী। নদীতে সেতু না থাকায় ওই হাওরে উৎপাদিত ধান নৌকা দিয়ে বহন করতে হয়। এতে সময়, শ্রমিকের মজুরি ও দুর্ভোগ বাড়ছে। তাই জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাগবে সেখানে একটি পাকা সেতু নির্মাণ জরুরি বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)