কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে শুরু হচ্ছে ৯দিনব্যাপী মধুমেলা
এস আর সাঈদ : যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে বাংলা সাহিত্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধূসূদন দত্তের ২০০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মধুমেলা শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে। এ মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়িকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। কপোতাক্ষ নদ পাড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মধুভক্তের উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠবে মেলা প্রাঙ্গন। মেলা চলবে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। বিকাল ৫টায় প্রধান অতিথি হিসাবে উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস’র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার অধ্যাপক প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।
মধু মঞ্চে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মধু মেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আরবাউল হাসান মজুমদার। স্বাগত বক্তব্য রাখেবেন মধু মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তুহিন হোসেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখবেন শেখ আফিল উদ্দিন এমপি, মোঃ তৌহিদুজ্জামান, কাজী নাবিল আহম্মেদ এমপি, এনামূল হক বাবুল এমপি, মোঃ ইয়াকুব আলী এমপি, আজিজুল ইসলাম এমপি, যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, যশোর জেলা পরিষদের চোরম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল ও কেশবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব কাজী রফিকুল ইসলাম।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম রুহুল আমিন, প্রেসক্লাব যশোরের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন, যশোর জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. মাহমুদ হাসান বুলু ও সাগরদাঁড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মোস্তাফিজুল ইসলাম মুক্ত।
উপস্থাপক হিসাবে থাকবেন যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার মোঃ আবু নাছির ও যশোর জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাধন কুমার দাস। মেলার উদ্ধোধনের পর সন্ধ্যায় মধুমঞ্চে অতিথিদের আলোচনা সভা শেষে মধু মঞ্চে নাটক, যাত্রাপালা সহ মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
প্রতিবারের ন্যায় মেলায় আগতদের মাঝে মেলা আকর্ষণীয় করে তুলতে মেলার উন্মুক্ত মঞ্চে কবিতা আবৃতি, নাটক, যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া মেলার মাঠে আনন্দ উপভোগের জন্য সার্কাস, মৃত্যুকুপ, নাগোরদোলা, যাদু প্রদর্শনী, কৌতুকসহ বিভিন্ন বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মেলার মাঠে বসবে নানা ধরনের আকর্ষনীয় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মধুমেলা উদযাপন কমিটির সভাপতি যশোর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আরবাউল হাসান মজুমদার মধুমেলা অশ্লীলতামুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মধুমেলাতে সব কিছু শালীনতার মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করার জন্য কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ‘৮০ দশকে মধু কবির জন্মভূমি সাগরদাঁড়ীর ‘পৈত্রিক বসতবাড়ি’ প্রত্বতত্ত¡ অধিদপ্তর সার্বিক পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পরে কিছুটা ঘষামাজা করে পুরাতন জীর্ণশীর্ণ ভগ্নদশা থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালে কবির জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলা উদ্বোধন কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাগরদাঁড়িতে পর্যটন কেন্দ্র ও মধুপলী গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। যার প্রেক্ষিতে পর্যটনের ১টি মধুপলী নির্মাণ করা হয়। যা এখানে আসা মধুপ্রেমীদের মনে দোলা তুলে স্মরন করিয়ে দেয় মধু কবির অতীত জীবন, স্বনামখ্যাত ঐতিহ্যবাহী যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ প্রাণের কবি, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্থানীয় জমিদার পিতা রাজনারায়ন দত্ত আর মাতা জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বাঙ্গালীর প্রিয় কবি এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হন। প্রাকৃতিক অপূর্ব লীলাভূমি, পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা, শষ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ সাগরদাঁড়ী গ্রাম আর বাড়ির পাশে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের সাথে মিলেমিশে তার সুধা পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে পরিনত যুবক হয়ে উঠেন। কপোতাক্ষ নদ আর মধুসূদন” দু’জনার মধ্যে গড়ে উঠে ভালবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।
মধুকবি ১৮২৪ সালে যখন জন্মগ্রহণ করেন সে সময়ে আজকের এই মৃত প্রায় কপোতাক্ষ নদ কাকের কালো চোখের মত স্বচ্ছ জলে কানায় কানায় পূর্ন আর হরদম জোঁয়ার ভাটায় ছিল পূর্ণযৌবনা। নদের প্রশান্তবুক চিরে ভেসে যেত পাল তোলা সারি সারি নৌকার বহর আর মাঝির কন্ঠে শোনা যেত হরেক রকম প্রাণ উজাড় করা ভাটিয়ালী ও মুর্শিদি গান। শিশু মধুসূদন এ সব অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখত আর মুগ্ধ হয়ে যেত। স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের অবিশ্রান্ত ধারায় বয়ে চলা জলকে মায়ের দুধের সাথে তুলনা করে কবি তাই রচনা করলেন সেই বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘কপোতাক্ষ নদ’।
তিনি লিখলেন- ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে’।
ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় মাওলানা লুৎফর রহমানের কাছে শিশু মধুসূদন তার শিক্ষা জীবন শুরুকরেন। পাশাপাশি গৃহ শিক্ষক হরলাল রায়ের কাছে বাংলা ও ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু গাঁয়ের পাঠশালায় তিনি বেশি দিন শিক্ষা লাভ করতে পারেননি।
আইনজীবি পিতা রাজনারায়ন দত্ত কর্মের জন্য পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকে ইংরেজী ভাষার প্রতি দূর্বল হয়ে পাড়ি জমান পশ্চিমা দেশ ফ্রান্সে। অবস্থান করেন ভার্সাই নগরীতে। বিদেশী ভাষায় জ্ঞানার্জন করার পাশাপাশি এখানে বসেই তিনি রচনা করেন বাংলায় সনেট বা চর্তুদ্দশপদী কবিতা। সেখানে চলাফেরার এক পর্যায়ে মধুসূদন পর্যায়ক্রমে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে ভয়ংঙ্করভাবে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্থ ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ফিরে আসেন আবারো কলকাতায়। এসময় তার পাশে ২য় স্ত্রী ফরাসি নাগরিক হেনরিয়েটা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার একটি হাসপাতালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পেছনে ফেলে রেখে যান একগুচ্ছ মনোকষ্ট আর অভিমান। মহাকবির মৃত্যুর পর ১৮৯০ সালে মহাকবির ভাইয়ের মেয়ে মানকুমারি বসু সাগরদাঁড়িতে প্রথম স্মরণসভার আয়োজন করেন। সেই থেকে শুরু হয় মধু জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলা।
মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ তুহিন হোসেন বলেন, মেলায় মধুভক্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একটি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ও পাশাপাশি ডিবি, জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাথে প্রয়োজন মতো সাদা পোশাকে পুলিশ ও র্যাব-৬ বলবৎ থাকবে। এছাড়া মাঠে একাধিক নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ করা হবে। স্থানীয় ভাবে শতাধিক যুবকদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেচ্ছাসেবক বাহিনী। মধুমঞ্চে নয়দিনব্যাপী কেশবপুর ও যশোরের শিল্পীগোষ্ঠীর পাশাপাশি দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীরা অংশ নেবেন।
কেশবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ জহিরুল আলম বলেন, অতীতের ন্যায় মধুমেলাকে নিয়ে কোন বির্তকের সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। যে কোন উপায়ে মেলার সুশৃংঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন ইতে মধ্যে সব ব্যবস্থা গ্রহন করেছে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)