খুলনার আংটিহারা শুল্ক স্টেশন কর্মচারির অপরাধ সাম্রাজ্য, মাসিক আয় অর্ধ কোটি টাকা
মো: ইকবাল হোসেন, কয়রা (খুলনা): খুলনার কয়রা উপজেলার আংটিহারা স্থল শুষ্ক স্টেশনে কর্মরত অফিস সহায়ক আবু বকর তার দাপ্তরিক পরিচয়ের আড়ালে গড়ে তুলেছেন বিশাল মাদক ও সুন্দরবনকেন্দিক বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক তিনি।
তার অধীনস্থ বাহিনীর মাধ্যমে মাদক পাচার থেকে শুরু করে, জাহাজের তেল চুরি এবং সুন্দরবন কেন্দ্রিক নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। সাম্প্রতিক কাস্টমস এর পুরাতন ভবন টেন্ডার ছাড়া ভেঙ্গে লক্ষ লক্ষ টাকার মালামাল হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
এভাবে এক সময়ের নিঃস্ব আবু বকর এখন কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তার মাসিক আয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে সব কিছুই মিথ্যা ভিত্তিহীন ও মনগড়া বলে দাবি করেন আবু বকর। তিনি কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামের মৃত আমিন গাজীর ছেলে। ২০১২ সালে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনে যোগদানের পর থেকে সেখানেই কর্মরত আছেন।
এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে থানা একাধিক সাধারণ ডায়েরি ও অভিযোগ রয়েছে। তার অপরাধের বিষয়ে মুখ খোলায় লক্ষণ মুন্ডা ও রুহুল আমীন গাজী নামে স্থানীয় দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে হরিণের মাংস রেখে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। যার অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসলে বিষয়টি নিয়ে এলাকায় সমালোচনা শুরু হলে তার অপরাধের নানা চিত্র বেরিয়ে আসতে শুরু করে।
মাঝি হিসেবে দায়িত্ব নেয় বক্কর অফিস সহায়ক না হয়েও পরিচয় দিতেন অফিস সহায়ক। ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ স্থানীয় এমপি, খুলনা বিভাগীয় কাস্টমস কমিশনার ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন লক্ষণ মুন্ডা। লক্ষণ মুন্ডা স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সুন্দরবন কমিউনিটি পেট্রোলিং টিমের সদস্য। তিনি এক সময় শুল্ক স্টেশনের মাঝি হিসেবে অস্থায়ীভাবে কাজ করতেন।
স্থায়ী নিয়োগ পেতে তিনি আবু বকরকে এক লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। লিখিত অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, আবু বকরের বিরুদ্ধে হরিণ শিকার, জাহাজের তেল চুরি ও মাদক পাচারের বিষয়ে মুখ খোলায় তার অস্থায়ী নিয়োগ বাতিল করা হয়। পরে তার কাছে টাকা ফেরত চাইলে নানা হুমকি দিতে শুর“ করেন। এক পর্যায়ে তার আত্মীয় ভৈরব রায়কে হরিণের মাংস দিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেন আবু বকর।
লক্ষণ মুন্ডা জানান, ভারত থেকে সিমেন্টের কাঁচামালবাহি জাহাজে কর্মরতদের ম্যানেজ করে ফেন্সিডিল, মদ, গাজা ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন আবু বকর। সে অফিসের স্টাফ না হয়েও নিজেকে অফিস সহায়ক পরিচয় দিয়ে পোষাক পরে অফিসের সকল কাজ করেন৷ মাদক পাচারের রুট নিয়ন্ত্রণের কারণে তিনি বেশিরভাগ সময় কর্মস্থলের বাইরে থাকেন। তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় এই মাদক।
আবু বকরের অপরাধ সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে তার ভাই আলমগীর গাজী, তানভীর গাজী, ভাগনে আলমগীর হোসেন, অলিউর রহমান বাবু, তৈয়বুর গাজী অন্যতম। এদেরকে দিয়ে জাহাজের মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার কাজ করিয়ে থাকেন। অফিসে জনবল কম থাকায় দাপ্তরিক যাবতীয় কাজও তিনি করেন। এ কারণে জাহাজের নাবিক, মাস্টারকে সহজেই বশে রাখেন তিনি। এলাকায় প্রবচন রয়েছে বক্কর প্রভাবশালীদের মদ দিয়ে খুশি রাখেন যারা তারা তার সার্পোট দেন।
অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ৮০/৯০ টি ভারতীয় জাহাজ আংটিহারা কাস্টমস অফিসে আসে। প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ হইতে ৪০/৫০ লিটার ডিজেল তৈল তাহাকে বাধ্যতামূলক দিতে হয় যাহার আনুমানিক ৪,৭২,৫০০/- টাকা।জাহাজ বকরের বেধে দেয়া টাইমের বাইরে নোঙর করিলে জরিমানা আদায় করা হয় প্রতিমাসে সে জরিমানা বাবদ প্রায় ৩,০০,০০০ টাকা আদায় করে।
কাস্টমস অফিস হইতে ছাড়পত্র নিতে প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ থেকে ১০,০০০ টাকা হিসাবে মাসে ৯০টি জাহাজে ৯,০০,০০০ টাকা আদায় করে। ভারতীয় জাহাজে চাউল, গম, ভুট্টা, ভুসি এবং লোহার গুড়া থাকিলে প্রতিটি জাহাজে ১০,০০০ টাকা হিসাবে প্রতিমাসে ২৫/৩০টি জাহাজ হইতে অনুমান ৩,০০,০০০/- টাকা আদায় করিয়া থাকে।
প্রতিটি জাহাজে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়া নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রতিটি জাহাজ কাস্টমস অফিসে আসা যাওয়া বাবদ ৫০০+৫০০=১০০০/- টাকা হিসাবে প্রতি মাসে অনুমান ৬,০০,০০০/- টাকা আদায় করে থাকে। প্রত্যেকটি বাংলাদেশ ও ভারতীয় জাহাজ কাস্টমস অফিসে তদন্ত করিতে অফিসিয়াল খরচ ২,৬০০ টাকা থেকে ৩০০/- টাকা বক্কার গাজী পেয়ে থাকে। যাহা সে প্রতিমাসে আনুমানিক ৩,৬০,০০০ টাকা নিয়ে থাকে।
পানি সরবরাহ না করে বি,আই,ডবিউ টিএ এর পাইলটদের পানির খরচ বাবদ বি আই ডবিউ টিএ এর অপারেটর মনোহরের মাধ্যমে প্রতিমাসে ২০,০০০/- টাকা আদায় করে থাকে। জাহাজের ড্রাইভার ও মিস্ত্রিদের নিকট হইতে অবৈধ তৈল ক্রয় বিক্রয় করিয়া প্রতি মাসে অনুমান ২,০০,০০০/- টাকা আদায় করে থাকে।
এছাড়া অবৈধ আয় থেকে খুলনা শহরের রুপসা ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে তথ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ৩৪,০০,০০০ দিয়ে বিলান জমি ক্রয়। খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা থানাধীন ২নং আবাসিক এলাকায় ৩৭,০০,০০০ টাকা মূল্যের ১টি ফ্ল্যাট ক্রয়। খুলনা শহরের সোনাডাঙ্গা থানাধীন নতুন আবাসিক এলাকায় ৯৫,০০,০০০ টাকা মূল্যের ১টি ফ্ল্যাট। দৌলতপুর থানাধীন মহসীনরোড সংলগ্ন চৌরাস্তা মোড়ে ০২ কাঠা জমির উপর ০২ তলা বিশিষ্ট একটি পাকা ভবন আনুমানিক মূল্য ৬০,০০,০০০ টাকা।
খুলনা শহরে ২টি সিএনজি ভাড়া দেওয়া আনুমানিক মূল্য ১৬,০০,০০০ টাকা।তার জামাই কামাল হোসেন এর খুলনা বড় বাজারে পাইকারীর দোকানে প্রায় ২,০০,০০,০০০/- (দুই কোটি) টাকা বিনিয়োগের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
আবু বকরের রোষানলের শিকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন গাজী জানান, আংটিহারা ল্যান্ড কাস্টমসের নতুন ভবন যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ওই জমি ছিল স্থানীয় বাসিন্দা কালিপদ শীলের। আবু বকর সামান্য টাকায় বন্ধক রেখে জাল দলিলের মাধ্যমে দখল করেন। পরে তা কাস্টমস অফিসে বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন এলাকায় কাস্টমস হাউজ মাদকের আখড়া নামে পরিচিত হয়েছে বকরের মাদক সিন্ডিকেটের কারণে।
তার প্রতিবেশী শিক্ষক মশিউর রহমান জানান, আবু বকরের বাবা ছিলেন বনজীবী। তাদের তেমন কোন সহায় সম্পদ ছিল না। বসবাস করতেন খাস জমিতে। কাস্টম অফিসে যোগদানের পর থেকে তার অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। বর্তমানে তার স্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা। খুলনার সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার ২ নম্বর সড়কে দেড় কোটি মূল্যের ৫ শতাংশ জমি আছে তার।
এছাড়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে কয়রা উপজেলা সদরের কাছে কয়রা মৌজায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ২৫ বিঘা জমি কিনেছেন। এলাকায়ও তার ৩ বিঘা ভিটাবাড়িসহ ১৫ বিঘা জমি রয়েছে। যার দাম প্রায় এক কোটি টাকা। শোনা যায় একটি জাহাজাও কিনেছেন তিনি।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম খান বলেন, আবু বকর যে চাকরি করেন তা দিয়ে এতো সম্পদের মালিক হওয়া সম্ভব না। বর্তমানে তিনি কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না। এমনকি জনপ্রতিনিধিদেরও তাকে সমীহ করে চলতে হয়। তার বিরুদ্ধে মাদক পাচার, হরিণ শিকার ও জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সে কাস্টমস এর পুরাতন ভবন টেন্ডার ছাড়া ভেঙ্গে নিজেই কাজে লাগিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাহাজের একাধিক মাস্টার বলেন, আমরা এক প্রকার আবু বকরের কাছে জিম্মি। কারণ সে কাস্টমস হাইজের সকল কাজ করে থাকে। অনেক সময় তার কথা মত বিভিন্ন অবৈধ জিনিস আনতে বাধ্য হই নইলে আবু বকরের দ্বারা বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়।
জানতে চাইলে অফিস সহায়ক আবু বকর তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বার বার একটি স্বার্থনেশী মহল তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আমার নামে বিভিন্ন জায়গায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে থাকেন। মূলত আমি এখানে থাকলে তারা অপকর্ম করার সুযোগ পায়না। এ কারণে এসব বানোয়াট মিথ্যা ভিত্তি অভিযোগ করেছেন তারা। আমি মাঝি ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম বর্তমানে সেখানেও আমি নেই৷
জাহাজে করে মাদক এনে তা পাচার করা অসম্ভব ব্যাপার জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কেউ টাকা পয়সার মালিক হলে এলাকার মানুষের চোখে পড়ে। একটি পক্ষ বার বার উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে আমার হয়রানি করছে। আংটিহারা নৌ পুলিশের ইনচার্জ মাহমুদ বলেন, এখানে নতুন যোগদানের পর থেকে আমার কাছে ওভাবে তার কোন অভিযোগ আসেনি আমিও পায়নি।
তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে যারা এই অপরাধ গুলো করে তারাই অভিযোগ করছে তার বিরুদ্ধে। তবে আপনারা বলছেন খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। কয়রা থানা অফিসার ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ পেয়েছি৷ ঊর্ধ্বতন স্যারদের অবগত করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের সাবেক এক পরিদর্শক বলেন, অফিসে জনবল কম থাকায় একই ব্যক্তিকে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়।
তাছাড়া আমাদেরকে প্রতি ১৫ দিন পর পর বদলি হওয়ায় নতুন লোক যায় যার কারণে অফিস সহায়ক আবু বকরকে স্থায়িভাবে রাখা। সেই সুবাদে অফিসের প্রায় সকল কাজ সে ও তার লোক করে থাকে। সেই সুবাদের জাহাজের সকল লোকদের সাথে তার একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়। তবে অনৈতিক লেনদেন ও মাদক পাচার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একটি জাহাজ থেকে ৮২ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। তবে এর সঙ্গে আবু বকর জড়িত আছে কিনা জানা নেই।
আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের পরিদর্শক হিদায়াতুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমি নতুন এসেছি যতটুকু জেনেছি সে অফিস সহায়ক নয় সে মাঝি হিসাবে জাহাজের লোক ও আমাদেরকে জাহাজে আনা নেওয়া করে।মাঝি হয়েও কীভাবে অফিসের সকল কাজ করেন পোষাক পরে এমন উত্তরে তিনি বলেন আপাতত আমি এসে তাকে এখানে তো সেভাবে দেখছি না কাজ করতে। আর অপরাধের বিষয়ে তার জানা নেই বলে জানান তিনি।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)