চেতনায় ’৭১: মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানব সভ্যতা এবং আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ও অর্জনের অমূল্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধ জাতির জীবনের বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অফুরন্ত প্রেরণা উৎস, জাগ্রত চেতনার নাম, জাতির বিবেকের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আনন্দ বেদনায় মিশ্রিত এক নীরব দলিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, অকুতোভয় সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সংগঠকদের চরম ত্যাগের অমর বীরত্ম কাহিনী। পশ্চিমা সা¤্রজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতাদাঞ্চলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আপামর জনসাধারণকে সাথে নিয়ে মুক্তির সংগ্রাম করেছেন। ইতিহাসে ঈশা খাঁ থেকে ক্ষুদিরাম, বাঘা যতিন তার জ্বলন্ত প্রতীক।
প্রতিটি ক্ষেত্রে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠির নিদারুণ বৈষম্যের যাতাকালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতি নির্যাতিত, অবহেলিত ও নিষ্পেষিত হয়েছিলো। ১৯৫২ এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’এ সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিমাদের নিষ্পেষণ, নির্যাতন, বৈষম্য, হত্যা ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে চেতনার বহি:প্রকাশ ঘটায়।
ক্ষমতা হস্তান্তের পরিবর্তে পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠি বেছে নিয়েছিলো দমন ও নিপীড়ণের পথ। কোটি কোটি বাঙালির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গত দাবি অগ্রাহ্য করে সেদিন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী পৃথিবীর মানব ইতিহাসে জঘণ্যতম ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিলো। শোষনের ও গোলামীর জিঞ্জির ছিন্ন করে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং পাক বাহিনীর নৃশংসতা মোকাবেলা করার জন্য সর্বত্র শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, মুক্তির সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। বস্তুত: ভাষা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে বপনকৃত বীজের ফসল এবং বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফলশ্রুতি হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আন্দোলন।
বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ প্রাক্তন এমএলএ, এমপিএ মমতাজ আহমদ, শিক্ষক নেতা ও ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ, বিএম নজরুল ইসলাম, বাবু শ্যামাপদ শেঠ প্রয়াত, তারক নাথ ঘোষ, হোসেন আলী, এসএম এন্তাজ আলী, এমএ করিম, মোসলেম উদ্দীন, ডা.আহমদ হোসেন খাঁনসহ ১৩ সদস্য বিশিষ্ট স্বাধীনবাংলা সংগ্রাম পরিষদের কলারোয়াঞ্চলের কমিটি গঠিত হয়।
এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে কলারোয়া থানার সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এছাড়া কলারোয়ায় মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য কয়েকজন বিশিষ্ট সংগঠকদের মধ্যে খোরদো-বাটরা গ্রামের আনোয়ার হোসেন, জয়নগরের এসএম রিয়াজ উদ্দীন ও যুগিখালী গ্রামের মো.রিয়াজ উদ্দীনের নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে তারা আঞ্চলিক সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রথমত অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে প্রয়াত মোসলেম উদ্দীন, আব্দুল গফফার, আব্দুর রউফ, প্রয়াত হাবিবুর রহমান, আবুল হোসেন (১), সৈয়দ আলী গাজী, আবুল হোসেন (২), আবু বকর, গোলাম মোস্তফা, প্রয়াত জাকারিয়া, কেঁড়াগাছি গ্রামের প্রয়াত আতিয়ার রহমানসহ অনেকের নাম বার বার উঠে আসে।
পরে অবশ্য কলারোয়া থানা থেকে তৎকালীন ৩৪৩ জন দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাঁদের অসীম বীরত্বের পরিচয় জাতি শ্রদ্ধার সাথে আজো স্মরণ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মোসলেম উদ্দীন (প্রয়াত) ও আব্দুর গফফার দু’জন যুদ্ধকালীন সময়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ প্রাক্তন এমএলএ, এমপিএ মমতাজ আহমদ (প্রয়াত) আঞ্চলিক স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এবং প্রবাসী সরকারের ৮নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি ছিলেন দেশবরেণ্য শিক্ষক নেতা ও ভাষা সৈনিক শেখ আমানুল্লাহ (প্রয়াত)। প্রকাশ থাকে যে, মমতাজ আহমদ ৮নং সেক্টরে রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হওয়ার পর বিএম নজরুল ইসলাম (প্রয়াত) সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া ছিলো ৮নং সেক্টরের অধীন। ৮নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ৭১’র জুলাই মাসের শেষের দিকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পান মেজর আবুল মঞ্জুর। সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দীন (এক মাস), ঝিনাইদহের এসডিপিও ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন বীর বিক্রম (দুই মাস)। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী ও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ বীর প্রতীক ৮নং সেক্টরের যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী প্রথম কলারোয়ায় পৌঁছিয়েই হত্যা ও লুন্ঠন শুরু করে। ৩০ এপ্রিল পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হন মাহমুদপুর গ্রামের নিরীহ কৃষক আফসার উদ্দীন গাজী। অকারণে তাঁকে মাঠের মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এরপর মুরারীকাটি গ্রামের পালপাড়ায় (চিত্রপুর) পাকসেনারা বর্বর ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বৈদ্যনাথ পাল, নিতাই চন্দ্র পাল, রঞ্জন পাল, বিমল পালসহ ৯জন নিরপরাধ কুম্ভকারকে হত্যা করে।
এরপর বামনখালীর ঘোষপাড়ায় রাজ কুমার ও খগেন ঘোষকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা।
পার্শ্ববর্তী মনিরামপুর থানার ছিয়ানব্বই গ্রামের এক বিশাল শরনার্থী দল ঝাউডাঙ্গা অতিক্রম করার সময় গোবিন্দকাঠির মাঠে পাকসেনারা নির্বিচারে গুলি চালালে শত শত নর-নারী পাখির মতো লুটিয়ে পড়ে। সে এক বিভৎস দৃশ্য। মা শিশুকে জড়িয়ে, স্ত্রী রক্তাক্ত স্বামীর বুকের উপর চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
এরপর পাকসেনারা সোনাবাড়িয়ার চান্দা গ্রামের পোস্ট মাস্টার অজিয়ার রহমানকে, মাদরা গ্রামের কামাল মজুমদারকে এবং পাঁচপোতা গ্রামের আমিনুল ইসলাম ও আবু তাহের মাস্টারকে হত্যা করে। ওই অঞ্চলে নিরীহ শিবু পোদ্দারকে পেঁপে গাছে বেঁধে এবং হাজরা গাঙ্গুলিকে বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, ইপিআর জোয়ান ও অফিসারদের সঙ্গে ট্রেনিংপ্রাপ্ত কলারোয়ার মুক্তিকামী যুবকরা আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে কাকডাঙ্গা, বালিয়াডাঙ্গা, হিজলদী ও মাদরা আর্মি ক্যাম্পে প্রথম গেরিলা কায়দায় অতর্কিত আক্রমণে ও সম্মুখ যুদ্ধে পাক বাহিনীকে পর্যুদস্থ করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা ওইসব এলাকায় আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে থাকে।
কলারোয়ায় পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের ৭টি স্থানে মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। স্থানগুলোর মধ্যে বালিয়াডাঙ্গা, কাকডাঙ্গা, মাদরা, সোনাবাড়িয়া, নাথপুর, হিজলদী ও পার্শ্ববর্তী বাগআঁচড়া উল্লেখযোগ্য।
জুলাই-আগস্টের মধ্যে একদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫জন ছাত্র কলারোয়ার মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বামনখালীর জনৈক কুখ্যাত রাজাকারের হাতে আটক হয়। ২জন ছাত্র কৌশলে পালিয়ে গেলেও বাকী ৩জনকে পাকসেনারা কলারোয়া থানার পিছনে এনে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ২জন মারা যাওয়ার আগেই তাদেরকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়।
৩ সেপ্টেম্বর বালিয়াডাঙ্গায় পাকসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর তুমুল মুখোমুখি যুদ্ধে ৭/৮জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ওই যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা কলারোয়ার বৈদ্যপুরের জাকারিয়া, বাগাডাঙ্গার ইমাদুল, ই.বি রেজিমেন্টের লুৎফর রহমান ও শফিক চৌধুরী শহীদ হন।
১৭ সেপ্টেম্বর কাকডাঙ্গায় ফের সম্মুখ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমনের মুখে ১৭জন পাকসেনা নিহত হয় আর বাকিরা কাকডাঙ্গা ছেড়ে ঝাপাঘাট ও দমদমা ব্রিজের মুখে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে নাকিলা গ্রামের হাফিজসহ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৮ সেপ্টেম্বর হঠাৎগঞ্জ থেকে পাকসেনাদের একটি বৃহৎ দল কাকডাঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার খবরে বালিয়াডাঙ্গা বাজারের অনতিদূরে হঠাৎগঞ্জ পুকুর পাঁড়ে অবস্থান নিয়ে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহর নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ২৯জন পাক সেনাকে হত্যা করে।
এরপর বালিয়াডাঙ্গায় ২০ সেপ্টেম্বর পুনরায় ভয়াবহ দীর্ঘক্ষনব্যাপী সম্মুখ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু পাকসেনা নিহত হয়। শহীদ হন ১৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন কয়েকজন বীরসেনানী।
সেপ্টেম্বরের শেষভাগে বর্বর পাকবাহিনী মুক্তিসেনাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে চন্দনপুর ইউনিয়নের নাথপুর গ্রামে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করে গ্রামটি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয়। বর্বরদের প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রচন্ড যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে মুক্তিফৌজের সুবেদার তবারক উল্লাহ (ইপিআর) পাক বাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ আহত হন।
এর আগে ২৭ আগস্ট কমান্ডার মোসলেম উদ্দীন (প্রয়াত), আব্দুল গফফার, আব্দুর রউফ, আবু বকর (পরবর্তীতে শহীদ) সহ বীর মুক্তিযোদ্ধারা হিজলদী পাকবাহিনীর ঘাটিতে আক্রমন করলে ৩০ জনের মতো পাক সেনা নিহত হয়। ওই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ঘাটির পতন হলে কলারোয়া থানার মধ্যে সর্বপ্রথম অর্থাৎ ২৭ আগস্ট চন্দনপুর ইউনিয়ন পাক হানাদারমুক্ত হয়।
উল্লেখ্য, ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম কলারোয়া থানার কাউরিয়া গ্রামের আবু বকর পরবর্তীতে তালা থানার একটি খন্ডযুদ্ধে শহীদ হন।
অক্টোবরের শেষ দিকে চন্দনপুরের গেরিলা গ্রæপ পার্শ্ববর্তী যশোরের শার্শা থানার বাগআঁচড়া এলাকায় দু:সাহসিক আক্রমন চালিয়ে ৭জন পাক রেঞ্জার ফোর্সকে হত্যা করে। সেসময় আহাদুর ও আমজাদ নামের দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহত হন এবং নাকিলা গ্রামের ওমর আলী পাকসেনাদের হাতে আটক হন।
সেপ্টেম্বরে কলারোয়া অঞ্চলে সমগ্র মুক্তিফৌজকে ৫জন কমান্ডার যথা- মোসলেম উদ্দীন, আব্দুল গফফার, আবু বকর ছিদ্দিক, শেখ রফিক ও শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে ৫টি গেরিলা গ্রæপে ভাগ করা হয়। অক্টেবর-নভেম্বরে কলারোয়া অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা গ্রæপে তৎপরতা বৃদ্ধি পায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার লগ্নে প্রাক্তন এমএলএ মমতাজ আহমেদের ছোট ভাই তৎকালীন কেঁড়াগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এসএম এন্তাজ আলী হঠাৎ বিস্ফোরিত মটারসেলের প্রচন্ড আঘাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু বরণ করেন।
নভেম্বর মাস, স্বাধীনতা প্রায় দ্বারপ্রান্তে। পাকসেনারা ও দোসর রাজাকাররা মরিয়া হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছে। এসময় পাঁচনলের মতিয়ার রহমান, আব্দুর রশিদ ও শামছুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায় কলারোয়া থানার এক অবাঙালি সিপাহী। পিতার কাতর আর্তনাদে গভীর রাতে শামছুর রহমান মুক্তি পেলেও বাগআঁচড়ার জামতলা নামক স্থানে বাকি দু’জন এবং সেখানে আটককৃত আরো দু’জনকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। জামতালায় নাভারণ-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পূর্ব পাশে তাদের গণকবর দেয়া হয়। গণকবরের মাঝখানে সেই নৃশৃংস হত্যাকান্ডের নিরব সাক্ষি হিসেবে বর্তমানে বড় একটি বটগাছ বিদ্যমান।
চন্দনপুরের মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে অস্ত্র পরিষ্কার করার সময় অসাবধানতা বশত গুলি বেরিয়ে গেলে শাহেদ আলী ও নূর মোহাম্মদ শহীদ হন। তাদের কবর চন্দনপুর হাইস্কুলের সামনে গয়ড়া বাজারে।
গয়ড়া বাজারে ওই ২জন ছাড়াও কলারোয়া ফুটবল মাঠের দক্ষিন পাশে ৫জন, উত্তর মুরারীকাটির পালপাড়ায় ৯জন, সোনাবাড়িয়ায় ৬জন, বামনখালিতে ২জন, বালিয়াডাঙ্গায় ৭জন, ভাদিয়ালীতে ৪জন, শার্শার জামতলায় ৫জন সহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে শহীদদের কবর, গণকবর বিদ্যমান।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়ায় ৪৬জন শহীদ হন বলে জানা যায়। তাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধে কয়েকজন এবং পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও গুলিতে কয়েকজন শহীদ হন।
অকুতোভয় শহীদরা হলেন- পরানপুর গ্রামের মতিয়ার রহমান, বৈদ্যপুরের জাকারিয়া ও আব্দুস সালাম, পাঁচনলের আব্দুর রশিদ, তৎকালীন ইপিআর সদস্য লুৎফর রহমান, তৎকালীন ইপিআর সদস্য শফিক চৌধুরী, নাকিলা গ্রামের হাফিজ উদ্দীন, কাউরিয়া গ্রামের আবু বকর, চন্দনপুরের নূর মোহাম্মদ, বাগাডাঙ্গার ইমাদুল ইসলাম, বোয়ালিয়ার এসএম এন্তাজ আলী, মাহমুদপুরের আফছার উদ্দীন, কলারোয়া কলেজের ছাত্র আব্দুস সামাদ, লাঙ্গলঝাড়ার আব্দুল গণি, মুরারীকাটির বৈদ্যনাথ পাল, বামনখালীর রাজকুমার ঘোষ, খোরদো গ্রামের সোহরাব হোসেন, অজিয়ার সরদার ও কামিল সরদার, সুলতানপুরের বাহাদুর, ভাদিয়ালীর রজব আলী, একই গ্রামের এহসান আলী, গোয়ালচাতরের আব্দুর রশিদ, যুগিখালীর আব্দুল মান্নান, পাঁচপোতার আবু তাহের, হুলহুলিয়ার অজিয়ার সরদার, কেঁড়াগাছির কাশেম চৌকিদার, মুরারীকাটি পালপাড়ার নিতাই চন্দ্র পাল, রঞ্জন পাল, বিমল পালসহ ৮জন, বামনখালীর ঘোষপাড়ায় খগেন ঘোষ, সোনাবাড়িয়ার চান্দা গ্রামের পোস্ট মাস্টার অজিয়ার রহমান, মাদরা গ্রামের কামাল মজুমদার, পাঁচপোতা গ্রামের আমিনুল ইসলাম, চন্দনপুরে মুক্তিফৌজ ক্যাম্পের শাহেদ আলী, পাঁচনলের মতিয়ার রহমান, সোনাবাড়িয়া অঞ্চলে শিবু পোদ্দার ও হাজরা গাঙ্গুলি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না জানা ৩জন ছাত্র।
দীর্ঘ ৯মাস সশস্ত্র সংগ্রাম, বহু আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সোমবার কলারোয়া পাক হানাদারমুক্ত হয়। আর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মহান বিজয় দিবস।
জানা যায়- স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্তিমলগ্নে এসে ৬ ডিসেম্বর কলারোয়া পাক হানাদার মুক্ত হওয়ার দিনে গয়ড়া থেকে যুদ্ধকালীন কমান্ডার মোসলেম উদ্দীনের (প্রয়াত) নেতৃত্বে, খোঁরদো থেকে আব্দুল গফফারের নেতৃত্বে ও বালিয়াডাঙ্গাসহ পার্শ্ববর্তী সীমান্ত এলাকা থেকে ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ’র নেতৃত্বে সঙ্গীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা কলারোয়া সদরে উপস্থিত হন। সেদিন বীর সেনানীরা ও মুক্তিকামী জনতা কলারোয়া থানা ভবন চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্মরণে শিল্পপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমানের অর্থায়নে কলারোয়া পাইলট হাইস্কুল ফুটবল মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে যশোর-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কের পূর্ব পাশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্বাধীনতা’ নির্মিত হয়েছে। পৌরসভার কয়েকটি সড়ক কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)