রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে যেভাবে দেশ ছেড়েছিলেন আজিজ আহমেদের ভাই জোসেফ
সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজিজ আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ২০১৮ সালের ২৫ জুন। ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সময়ে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সোমবার সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে আজিজ আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, আজিজ আহমেদ তাঁর ভাইকে বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেন।
এটা করতে গিয়ে তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন।
এ ছাড়া অন্যায্যভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তিনি তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিনি নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন।
সেনাপ্রধান থাকাকালীন সময়েই আজিজ আহমেদের এ সব কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশ–বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে অসংখ্য সংবাদ ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং সহায়তা করা হয়েছে।
সন্ত্রাসী জোসেফের সাজা মওকুফের আবেদন থেকে শুরু করে দেশত্যাগ পর্যন্ত অসংখ্য সংবাদ প্রকাশ করেছে গনমাধ্যম।
‘জোসেফের সাজা মাফের আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে’ শিরোনামে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যমে সংবাদটি ছাপা হয়েছিল ২০১৬ সালের ২৮ জুন। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল- ‘দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের সাজা মওকুফের আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সাজা মওকুফের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চেয়ে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা ওই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ আবেদন পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরই তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের ইতিবাচক মতামত পেলেই তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়।
কোন বিবেচনায় আইন মন্ত্রণালয় সাজা মওকুফের বিষয়ে মতামত দেয়—জানতে চাইলে সেসময় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সার্বিক বিবেচনায় এ বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জোসেফ অসুস্থ এবং হৃদ্রোগের সমস্যায় ভুগছেন।
দুই সপ্তাহ ধরেই জোসেফের সাজা মওকুফের তোড়জোড় শুরু হয়। বহুল আলোচিত এই সন্ত্রাসীর খুনের দায়ে প্রথমে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। এই রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। পরে আপিল শুনানি শেষে গত বছরের ডিসেম্বরে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কারা সূত্র জানায়, জোসেফের মা রেনুজা বেগম ৭ জুন তাঁর সন্তানের সাজা মওকুফের জন্য আবেদন করেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে সাজা খাটানো হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন। এখন দ্রুত সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন পাঠাতে বিশেষ তদবির চলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে দু-এক দিনের মধ্যে এই সাজা মওকুফের আবেদন অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে পুরো প্রক্রিয়াটি চলে।
নব্বইয়ের দশকের শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ প্রায় ১০ মাস ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলে ছিলেন।
কারা সূত্র জানায়, সাজাপ্রাপ্ত এই কয়েদির বয়স ৪২ বছর। কারা বিবরণ অনুযায়ী, জোসেফ মোট সাজা খেটেছেন ১২ বছর ১৭ দিন এবং সাজা মওকুফ (রেয়াত) পেয়েছেন ৯ মাস ১৪ দিন। তাঁর সম্ভাব্য মুক্তির তারিখ জরিমানা দিলে ২০৩৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। আর জরিমানা না দিলে ২০৩৯ সালের ২৪ জানুয়ারি।
১৯৯৬ সালের ৭ মে মোহাম্মদপুরে ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি এই জোসেফ। ২০০৪ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মামলার অন্যতম আসামি জোসেফ ও মাসুদ জমাদারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন এবং অন্য তিন আসামি আনিস আহমেদ, হারিস আহমেদ ও কাবিল সরকারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
পরে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন জোসেফ, মাসুদ ও কাবিল। আসামি আনিস ও হারিস পলাতক থাকায় তাঁরা আপিল করতে পারেননি। ২০০৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের রায়ে জোসেফ ও কাবিলের সাজা বহাল থাকে এবং মাসুদ খালাস পান। এ ছাড়া অস্ত্র মামলায় জোসেফসহ অন্য আসামিদের ১২ বছর ও ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের সাজা মওকুফের জন্য আবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে এবার পরিবার নয়, এই প্রস্তাব পাঠিয়েছে খোদ কারা অধিদপ্তর।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলে, কারা অধিদপ্তর কারাবিধির ৫৬৯ ধারা অনুযায়ী সম্প্রতি এই প্রস্তাব পাঠিয়েছে। এই বিধি কোন ধরনের কয়েদিদের জন্য প্রযোজ্য, জানতে চাইলে এই ধারায় মুক্তির জন্য গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান ও মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কারা) মুহিবুল হক সেসময় বলেন, ২০ বছর সাজা খেটেছেন এমন কয়েদিদের মধ্যে যাঁরা খুব অসুস্থ, অক্ষম বা বৃদ্ধ তাঁদের জন্যই এ ধারা প্রযোজ্য। এ ছাড়া কেউ খুব ভালো আচরণ করলে তাঁর ক্ষেত্রেও ধারাটি প্রয়োগ হতে পারে। তবে বিতর্কিত কারও জন্য এ ধারা প্রযোজ্য হওয়ার কথা নয়।
অতিরিক্ত কারামহাপরিদর্শক ইকবাল হাসানের স্বাক্ষরিত ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ‘২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জোসেফের হাজতবাস তথা রেয়াতসহ প্রকৃত সাজা ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই কয়েদির মামলার সব কাগজপত্র আগেই পাঠানো হয়েছে। এ অবস্থায় কারাবিধির ৫৬৯ ধারা মোতাবেক অবশিষ্ট সাজা মওকুফের সিদ্ধান্ত দিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হলো।’
নব্বইয়ের দশকের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মোহাম্মদপুর এলাকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জোসেফ কোনো জটিল রোগ ছাড়াই টানা ২০ মাস হাসপাতালে ছিলেন। ৩ মে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর গত সোমবার দুপুরে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেও
য়া হয়।
সাজা মওকুফের আবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক সেসময় বলেন, ‘জোসেফের মতো সন্ত্রাসীর সাজা মওকুফ করা মানে হচ্ছে আমরা মগের মুল্লুকে আছি। এসব সাজা মওকুফ করার কথা মানবিক বিবেচনায় অর্থাৎ ব্যবহার যথেষ্ট ভালো বা এমন কোনো রোগে আক্রান্ত হলেন, যার জন্য মুক্তির প্রয়োজন, তাঁর ক্ষেত্রে।’
এসব বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের সাজা মওকুফের যে ক্ষমতা তা প্রয়োগ করতে হবে গভীর বিবেচনার মাধ্যমে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আইনে যখন কোনো বিশেষ ধারা থাকে তখন বুঝতে হবে ওই ধারা বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ ব্যক্তির জন্য। এখন এই ধারা যদি জোসেফের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তবে বুঝতে হবে সরকার জেনেবুঝে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে।
২০১৭ সালের ২৮ জুলাই আরেকটি সংবাদ প্রকাশিত হয় ওই পত্রিকার। শিরোনাম ছিল, ‘জোসেফসহ ৫৩ বন্দীর সাজা মওকুফ হচ্ছে’। সেখানে বলা হয়েছে-
‘শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফসহ ৫৩ বন্দীর সাজা মওকুফ করে মুক্তি দিচ্ছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি এসব বন্দীর তালিকা চূড়ান্ত করেছে। মন্ত্রী ও সাংসদদের দেয়া সুপারিশের ভিত্তিতেই এই তালিকা করা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র নিশ্চিত করেছে।’
তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফকে মুক্তি দেওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছিল সেনা প্রধান হিসেবে আজিজ আহমেদের দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগে। ২০১৮ সালের ২৫ জুন তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন, আর জোসেফ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান একই বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে।
প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে গত রোববার তাঁর সাজা মওকুফ করা হয়। ছাড়া পেয়েই গোপনে দেশ ছেড়েছেন তিনি।
কারা সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের জুন মাসে জোসেফের মা রেনুজা বেগম ছেলের সাজা মওকুফের জন্য আবেদন করেন। আইন মন্ত্রণালয় সাজা মওকুফের পক্ষে মতামত দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও ইতিবাচক মতামত পাঠানো হয়। এরপর প্রায় দুই বছর বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা শোনা যায়নি। জোসেফ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাঁকে ক্ষমা করার বিষয়টি জানাজানি হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, কারাবিধির ৫৬৯ ধারা অনুসারে কোনো বন্দী তাঁর সাজার মেয়াদের দুই-তৃতীয়াংশ খাটলে সেই বন্দীর বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ না থাকে, তবে সরকার চাইলে বিশেষ সুবিধায় তাঁকে মুক্তি দিতে পারে। সে অনুযায়ী জোসেফের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি তাঁর সাজা মওকুফ করে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছেন। এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে জোসেফ মালয়েশিয়ায় যান।’
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)