শেখ হাসিনাকে তৃতীয় দেশে পাঠানোর চেষ্টা সফল না হলে রাজনৈতিক আশ্রয় ভারতেই!
তিন সপ্তাহ আগে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি বিমানে দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করেন শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
গুঞ্জন রয়েছে তাদের সাথে ছিলেন আলোচিত সমালোচিত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তারেক সিদ্দিকিও।
ভারত সরকার এর পরদিন দেশের পার্লামেন্টে শেখ হাসিনার দিল্লিতে আসার কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করে। কিন্তু সেই অবতরণের পর পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে দিল্লিতে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় কিছুই জানানো হয়নি।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাবতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছেন, সরকারি পর্যায়েও কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি। তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হবে কি না, সেটা নিয়েও দিল্লি এখনও পর্যন্ত মুখ খুলছে না। ফলে ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা বাড়ছে, সঙ্গে ছড়াচ্ছে নানারকম গুজবও।
হেলিকপ্টারে সরিয়ে আনা বিষয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা ভারতে এসে নামার পর প্রথম রাতটি ছিলেন দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটির ভিভিআইপি লাউঞ্জে।
হিন্ডন মূলত একটি সামরিক বিমানঘাঁটি, তাই সেখানে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের থাকারও সুব্যবস্থা আছে। সেখানে প্রথম রাতটি কাটানোর পর তাকে গাজিয়াবাদেই (যা উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে পড়ছে) আধাসামরিক বাহিনীর একটি সেফ হাউজ বা অতিথি নিবাসে সরিয়ে আনা হয়েছিল বলে জানা যায়।
তবে এখন তাকে সেখান থেকেও সরিয়ে রাতের অন্ধকারে রাজধানী দিল্লিরই কোনও গোপন ঠিকানায় ‘মুভ’ করানো হয়েছে বলে জানা যায়। ফলে শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা এখন রয়েছেন দিল্লিতেই। আর এই ‘মুভ’টা কোনও গাড়িবহরে নয়, করানো হয়েছে আকাশপথে, হেলিকপ্টারে চাপিয়ে।
মেয়ে পুতুলের সঙ্গে দেখা হলো? বিষয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আঞ্চলিক কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে গত বছর থেকে মূলত দিল্লিতেই থাকেন। দক্ষিণ দিল্লির একটি অত্যন্ত অভিজাত এলাকায় খুব সুরক্ষিত পরিবেশে তার অফিস ও তার জন্য বাসা ভাড়া করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে শেখ হাসিনা যখন ৫ আগস্ট দিল্লিতে এসে নামেন, তিনি তখন ডব্লিউএইচওর কাজে থাইল্যান্ডে ছিলেন, পরে অবশ্য দ্রুত দিল্লি ফিরে আসেন।
শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসে নামার ঠিক আড়াই দিন পর (৮ আগস্ট সকালে) তিনি একটি টুইটে জানান, ‘এই কঠিন সময়েও মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারছি না, মাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না– আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে!’ বোঝাই যাচ্ছিল যেকোনও কারণেই হোক, এক শহরে থেকেও তখনও মা-মেয়ের দেখা হয়ে ওঠেনি।
তখন এটাও ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল, সায়মা ওয়াজেদ জাতিসংঘের একটি সংস্থার কর্মকর্তা বলেই তাকে ভারতে সাময়িক আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনা তার মা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু সায়মা ওয়াজেদের অন্য একটি পরিচয়ও আছে যেটা এই ধরনের সাক্ষাতের ক্ষেত্রে প্রোটোকলে আটকায়। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পুতুল কিন্তু সেই টুইটটি মুছে ফেলেন। পরে আর তিনি মা-কে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আর একটিও বাক্য লেখেননি।
দিল্লিতে একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন, ইতোমধ্যে মা ও মেয়ের মধ্যে শহরে একাধিকবার ‘ইন-পার্সন’ দেখা হয়েছে, কিন্তু সহজবোধ্য কারণেই সেই সব সাক্ষাতের কথা বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। ভারত বিষয়টিকে একেবারেই প্রচারের আলোর বাইরে রাখতে চাইছে।
এছাড়া দিল্লিতে মা ও মেয়ে আসলে এক সঙ্গেই বা এক ছাদের তলাতেই থাকছেন বলেও জানা যায়। যদিও নিরপেক্ষ কোনও সূত্র থেকে এই দাবির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
এদিকে সায়মা ওয়াজেদ তিন-চারদিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাজে পূর্ব তিমরে গিয়েছেন বলে জানা যায়।
ডিব্রিফিং সেশন বিষয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা যেরকম পরিস্থিতিতে ভারতে এসে পৌঁছেছেন সেরকম ক্ষেত্রে ‘অতিথি’কে ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ‘ডিব্রিফ’ করাটা রেওয়াজ। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এই ‘ডিব্রিফিং’ করার উদ্দেশ্য হলো ঠিক কোন পরিস্থিতিতে তাকে দেশ ছেড়ে আসতে হলো, সেসময় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার ভূমিকা কী ছিল, কে কী বলেছিলেন বা করেছিলেন, এগুলো সম্পর্কে যতটা বিশদে সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা। পাশাপাশি এখন ভারতে যেটুকু সময় তাকে থাকতে হচ্ছে, সেখানে ভারত তার কাছ থেকে ঠিক কী প্রত্যাশা করে, সেটা সম্পর্কেও তাকে সম্যকভাবে অবহিত করা। বেশিরভাগ সময় এই ডিব্রিফিং একটা সেশনে শেষ হয় না– পর পর বেশ কিছুদিন ধরে চালাতে হয়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও বেশ কতগুলো ডিব্রিফিং সেশন এর মধ্যেই হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে যেটা ব্যতিক্রম–তা হলো তার ‘ডিব্রিফিং সেশন’গুলো পরিচালনা করছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল নিজে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সম্মান, গুরুত্ব ও মর্যাদা বিবেচনায় ভারতের ‘স্পাই চিফ’ (গুপ্তচর প্রধান) নিজের কাঁধেই এই দায়িত্বটা তুলে নিয়েছেন বলে জানা যায়।
এর আগে ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় হিন্ডন বিমানঘাঁটিতেও শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন অজিত ডোভাল নিজে। ভারত সরকারের ‘শীর্ষতম মহলে’র সঙ্গেও শেখ হাসিনার গত কয়েকদিনের মধ্যে একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দিল্লিতে এই ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা ঠিক কারা, সেটা এখনই প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
শেখ হাসিনাকে তৃতীয় কোনও দেশে পাঠানোর চেষ্টা নিয়েও গুঞ্জন ওঠেছে।
জানা যায়, দিল্লিতে শেখ হাসিনার অবস্থান দীর্ঘায়িত হতে পারে– সেই সম্ভাবনা যেমন জোরালো হচ্ছে, পাশাপাশি ভারতের তরফে তৃতীয় কোনও ‘বন্ধু’ দেশে তাকে পাঠানোর চেষ্টাও কিন্তু মোটেই থেমে নেই। এখনও পর্যন্ত ভারত সরকারের ঘোষিত অবস্থান হলো, শেখ হাসিনা ভারতে এসেছেন ‘সাময়িকভাবে’। অর্থাৎ ভারত তার চূড়ান্ত গন্তব্য নয়, অন্য কোনও দেশে যাওয়ার পথে তিনি ভারতে থেমেছেন– এটাই এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লির বক্তব্য। তবে তিনি কতদিন ভারতে থাকতে পারেন, সেই ব্যাপারে ভারত সরকার এখন অবধি কিছুই বলেনি। পাশাপাশি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হবে কিংবা হবে না, সে ব্যাপারেও একটি শব্দও খরচ করা হয়নি।
গত ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা ভারতের মাটিতে নামেন, দিল্লির ধারণা ছিল কয়েক ঘণ্টা পরেই হয়তো তিনি যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দিতে পারবেন। সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হতে না পারায় এরপর ধীরে ধীরে দিল্লির তরফেই বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু হয়। এর জন্য প্রথমে যে কয়েকটি দেশকে ‘অ্যাপ্রোচ’ করা হয়েছিল সেগুলো হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপের দু-একটি দেশ (খুব সম্ভবত ফিনল্যান্ড, চেক ও স্লোভেনিয়া)। তবে শেখ হাসিনা কোনও দেশেই আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেননি, পুরো আলোচনাই চালানো হয়েছিল ভারতের তরফে। তবে যেকোনও কারণে কোথাও রাখার সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর আরেকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল, যারা ঠিক ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত নয়। এই দেশটি হলো মধ্যপ্রাচ্যের খুব প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শক্তি– কাতার। শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে কাতারের সঙ্গে ভারতের ‘ইনফর্মাল’ (অনানুষ্ঠানিক) আলোচনায় এখনও কোনও ‘ব্রেকথ্রু’ হয়নি ঠিকই, আবার সেই কথাবার্তা পুরোপুরি ভেস্তেও যায়নি। এই জটিল আলোচনা এখনও চলমান।
তবে শেষ পর্যন্ত কোনও উপযুক্ত তৃতীয় দেশে শেখ হাসিনাকে পাঠানোর চেষ্টা যদি সফল না-হয়, সেই ক্ষেত্রে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ভারতেই রেখে দেয়ার জন্য দিল্লি মানসিকভাবেও প্রস্তুত হচ্ছে। শেখ হাসিনা এই যাত্রায় দিল্লিতে পা-রাখার তিন সপ্তাহের মাথায় এটাই হলো ভারত সরকারের মনোভাবের সার কথা।
সৌজন্যে :বাংলা ট্রিবিউন, ইত্তেফাক
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)