খালেদা জিয়া: গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে উত্থান যেভাবে
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ১৯৮১ সালের ৩০মে যখন হত্যা করা হয় তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন দিশেহারা ও বিপর্যস্ত। জিয়াউর রহমান পরবর্তী দলের হাল কে ধরবেন—এ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। নেতাদের মধ্যে শুরু হয় কোন্দল।
তখন ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তার বয়স তখন আনুমানিক ৭৮ বছর। তখনকার রাজনীতিতে সাত্তারকে একজন বৃদ্ধ এবং দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হতো।
তাই দলের একটি অংশ চেয়েছিল কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্বের কাঠামো ঠিক করা হোক। কিন্তু অপর আরেকটি অংশ, যারা রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারে ছিলেন, তারা এর বিরোধিতা করেন।
প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ তার চলমান ইতিহাস : জীবনের কিছু সময় কিছু কথা বইতে লিখেছেন- সামরিক ও শাসকচক্রের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় ছিল খালেদা জিয়াকে নিয়ে। কারণ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার জন্য খালেদা জিয়াই সে সময় সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হতে পারতেন। কিন্তু তড়িঘড়ি করে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আব্দুস সাত্তারের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়।
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এইচ এম এরশাদ চেয়েছিলেন, সাত্তার প্রেসিডেন্ট হোক। বিষয়টি নিয়ে তখনকার বিএনপিতে মতভেদ দেখা দেয়। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেনা প্রধানের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ হয়েছে।
মওদুদ আহমদ লিখেছেন, বেগম জিয়া যদি প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চাইতেন, তাহলে অন্য কারো প্রার্থী হওয়ার তখন আর প্রশ্ন উঠতো না।
জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন তখন খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্যে খুব একটা দেখা যেত না। খালেদা জিয়া যখন রাজনীতিতে আসেন সেটা অনেককে চমকে দিয়েছিল।
সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান তার সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া শীর্ষক লেখায় তাকে বর্ণনা করেছেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেও লাজুক গৃহবধূরূপে তার দুই ছেলে তারেক রহমান (পিনো) এবং আরাফাত রহমান (কোকো)-কে নিয়ে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বার্ধক্য ও দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারণে তৎকালীন বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এর কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত; জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড তার মনে গভীর দাগ কেটেছিল এবং তিনি মানসিকভাবে সে ধকল কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
দ্বিতীয়ত; খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে পরিবারের দিক থেকে তেমন কোনো উৎসাহ ছিল না।
খালেদা জিয়ার জীবন নিয়ে প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ, হার স্টোরি বই লিখেছেন।
বছর তিনেক আগে যখন তিনি বেঁচে ছিলেন, তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, জিয়াউর রহমানের আকস্মিক হত্যাকাণ্ড তার মনের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিল। তিনি হয়তো ভাবতে শুরু করেছিলেন যে রাজনীতি হয়তো মানুষকে এ ধরনের করুন পরিণতির দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। রাজনীতির কঠিন পদযাত্রা সামলাতে পারবেন কিনা সেটি নিয়েও তার মনে প্রশ্ন ছিল। তাছাড়া পারিবারিকভাবে তার পিতা মেয়ের রাজনীতির ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না।
এসময় দলের নেতা-কর্মীরা রাজনীতিতে আসার জন্য দিনের পরদিন খালেদা জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি দলের হাল না ধরলে দল টিকবে না বলেও অনেকে বলেন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার বিষয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদের মনে ভয় ছিল বলে উল্লেখ করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কারণ এরশাদ যেহেতু ক্ষমতা দখলের দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ভাবছিলেন খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এলে পরিস্থিতি সামলানো তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বিবিসি বাংলাকে বলেন, খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম শিশু এবং একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। কর্নেল (অব.) আকবর হোসেন পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। নুরুল ইসলাম শিশু ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর। এছাড়া একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
কর্মী থেকে দলের চেয়ারম্যান
বিএনপি’র ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন। সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন।
একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন।
বিএনপি: সময়-অসময় বইয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন বিএনপিতে যোগ দেবার পর থেকে খালেদা জিয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া শুরু করেন।
আহমদ লিখেছেন, ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার এবং প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়াও উপস্থিত ছিলেন।
দলের তরুণ অংশ চেয়েছিল খালেদা জিয়া দলীয় প্রধান হোক। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে বিএনপি’র প্রধান হিসেবে দেখেতে আগ্রহী ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ।
বিএনপির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য একইসঙ্গে প্রার্থী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার।
বিএনপির ওয়েবসাইটে তখনকার ঘটনা বর্ণনা তুলে ধরে বলা হয়, এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিচারপতি সাত্তার দুবার বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় যান। বেগম খালেদা জিয়া তাকে তরুণ নেতৃত্বের মনোভাবে কথা জানান। এসময় বিচারপতি সাত্তার বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সহ-সভাপতির পদ এবং দেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান পদ থেকে তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তখন রাজনীতিতে সাত্তারের আর কোনো মূল্য থাকেনি। সাত্তার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান থাকলেও দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে।
১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপির কিছু নেতা সেটি পছন্দ করেননি। বিএনপির সেই অংশটি ভিন্ন আরেকটি জায়গায় বৈঠকের আয়োজন করে।
সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছিল তখন বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল থেকে খালেদা জিয়াকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেনন ছিলেন অন্যতম।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্য তারা দুজন তার তৎকালীন ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গিয়েছিলেন। রনো তার আত্মজীবনী ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে একথা তুলে ধরেছেন।
১৯৮০র দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে।
রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার শাসন আমল, ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ — এই দুইভাগে ভাগ করেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক। দুই হাজার এক সালে ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে খালেদা জিয়ার সরকার একের পর এক বিতর্কের মুখে পড়ে। সেই বিতর্ক থেকে তার দল ও সরকার আর বেরিয়ে আসতে পারেননি। দুই হাজার আট সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়।
এরপর তেকে দলটি রাজনৈতিকভাবে আরে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় তাঁর বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি।
দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সাল থেকে খালেদা জিয়া কারাগারে ছিলেন। ২০২০ সালে তিনি সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগারের বাইরে আসেন, তবে এজন্য নানা বিধিনিষেধ পালন করতে হয় তাকে, যার মধ্যে রয়েছে – রাজনীতিতে অংশ না নিতে পারা, বিদেশ যেতে না পারা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা, ইত্তেফাক
কলারোয়া নিউজে প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ। অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে কর্তৃপক্ষ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। (Unauthorized use of news, image, information, etc published by kalaroa News is punishable by copyright law. Appropriate legal steps will be taken by the management against any person or body that infringes those laws.)